
অন্তর্বর্তী সরকারের ১১ মাস পেরিয়ে গেলেও মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবগুলোতে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারছে না রাজনৈতিক দলগুলো। গত মার্চ মাস থেকে ঐকমত্য তৈরির প্রচেষ্টায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের একের পর এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বিমত থেকেই যাচ্ছে।
এই মতপার্থক্যের দায় দলগুলো একে অপরের কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছে; যা কেবল আলোচনা প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িতই করছে না, বরং সংস্কার কার্যক্রমের ভবিষ্যৎ ও প্রতীক্ষিত ‘জুলাই সনদ’ প্রকাশ নিয়েও জোরালো অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে মতৈক্যে পৌঁছালে জুলাইয়ের মধ্যে জাতীয় সনদ তৈরি করার লক্ষ্য ছিল কমিশনের।
জুলাই মাসের প্রথমার্ধ পেরিয়ে গেলেও মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবে একমত হওয়ার কোনো লক্ষণ এখনো দৃশ্যমান নয়। কমিশনের পক্ষ থেকে ৩০ বা ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে সনদ তৈরির আশা প্রকাশ করা হচ্ছে নতুন করে। যদিও কমিশনের সহ-সভাপতির কণ্ঠে ইতোমধ্যেই শোনা গেছে হতাশার সুর।
সোমবার (১৪ জুলাই) কমিশনের আলোচনা শুরুর আগে সূচনা বক্তব্যে সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর কাজের অংশীদার জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। যদি আমরা কোথাও ব্যর্থ হই, সে ব্যর্থতা আমাদের সবার। কমিশন যদি ব্যর্থ হয় তাহলে এটা সবার মিলিত ব্যর্থতা হবে। ’
তিনি আরও বলেন, ‘কিছু মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর মাধ্যমে একটি জাতীয় সনদে উপনীত হতে হবে; সেটি যেকোনো প্রক্রিয়ায় ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে হবে। বড়জোর ৩১ জুলাইয়ে যেতে পারি। ’
এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে খানিকটা ছাড় দিয়ে হলেও এক জায়গায় আসার আহ্বান জানান কমিশনের সহ-সভাপতি।
তবে যে প্রক্রিয়ায় জাতীয় ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা চলছে, তাতে কতটা সফলতা আসবে, তা নিয়ে ইতোমধ্যেই সংশয় প্রকাশ করেছে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা। সংস্কার প্রস্তাবনায় অনেক বিষয়ে নিজেদের আগের অবস্থান থেকে সরে এসে কিছু কিছু দল যেমন একমত হচ্ছে, আবার কিছু দল নিজেদের অনড় অবস্থান থেকে একচুলও ছাড় দিচ্ছে না।
ঘুরে ফিরে একই বিষয় একাধিকবার আলোচনায় আসাতেও বিরক্তি প্রকাশ করেছে কিছু রাজনৈতিক দল। দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা হলেও এই বিষয়গুলোতে আশানুরূপ ফল আসেনি বলে জানিয়েছে তারা। অমীমাংসিত বিষয়ের ভবিষ্যৎ নিয়েও দেখা দিয়েছে শঙ্কা। তবে এখনো আলোচনার মাধ্যমেই সমাধানে আস্থা রাখতে চায় ঐকমত্য কমিশন।
এখন পর্যন্ত কমিশনের আলোচনায় সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি, প্রধান বিচারপতির নিয়োগ প্রক্রিয়া, রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বিধান নিয়ে আইন প্রণয়ন, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ ও উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত স্থাপন- এই ৭টি বিষয়ে একমত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো।
নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে- সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য প্রস্তাবিত কমিটি (যা আগে ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি নামে প্রস্তাবিত ছিল); দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের কাঠামো, বিশেষত উচ্চকক্ষের গঠন, সদস্য মনোনয়ন ও নির্বাচনের পদ্ধতি এবং এখতিয়ার।
মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের বিষয়ে আবারও আলোচনা হয়। কয়েকবার আলোচনার পরও এই ইস্যুতে দলগুলো নির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। একদিকে কোনো কোনো দল বলছে, ভোটের সংখ্যানুপাতে যেন উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হয়। অন্যদিকে আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতেও উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব আছে। যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলো এবং জোটগুলো এ বিষয়ে কোনো ঐকমত্যে পৌঁছতে পারছে না, তাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্তের ভার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে দিয়েছে দলগুলো।
সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা বৃদ্ধি কিংবা সরাসরি নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়েও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ধরন, রাষ্ট্রের মূলনীতি পুনর্বিন্যাস, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল নির্ধারণ, প্রধান বিচারপতির নিয়োগপদ্ধতি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামো ও গঠন প্রক্রিয়ার ইস্যুতেই রয়েছে মতপার্থক্য।
এছাড়া বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, নাগরিকের মৌলিক অধিকারসমূহের সম্প্রসারণ এবং প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ও দায়িত্ব পুনঃনির্ধারণ সম্পর্কিত প্রস্তাবনাগুলোর ক্ষেত্রেও এখনো ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি। ফলে কমিশনের আলোচনায় উত্থাপিত গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাবগুলো এখনো ঝুলে থাকা অবস্থায়। সামনের দিনগুলোতেও আলোচনার পর এ বিষয়গুলোতে ঐকমত্যে না পৌঁছানো না গেলে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের মতো অন্য বিষয়গুলোতেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার কমিশনের ওপর পড়ে কি না, এটাই এখন দেখার বিষয়।
এত আলোচনার পরও ঐকমত্যে না পৌঁছানো প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘সব বিষয়ে একমত হতে হবে কেন? জাতীয় ঐকমত্য পোষণ হলে যেসব বিষয়গুলোতে একমত হবে, সেসব নিয়ে জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ স্বাক্ষর হওয়ার কথা। এখন যদি আমাদের বাধ্য করা হয়, সব বিষয়ে একমত হতেই হবে, সেটা তো ঠিক হলো না। মতভিন্নতা তো থাকবেই। ’
তবে মৌলিক বিষয়ে সংস্কার না করে নির্বাচনের পক্ষে নয় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। জামায়াতের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মৌলিক বিষয়ে কোনোভাবেই যদি একমত না হওয়া যায়, তাহলে তারা মনে করছেন, আওয়ামী লীগ আমলের সিস্টেম রেখেই নির্বাচন করা হবে, যা গ্রহণযোগ্য হবে না।
মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন অভিযোগ করে বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চলমান সংলাপে সব দল ছোটখাটো সংস্কার প্রস্তাব মেনে নিলেও মৌলিক সংস্কারের বিষয়গুলো উত্থাপন হলেই বিএনপি ও গুটিকয়েক দল সেখানে বাধা সৃষ্টি করছে।
এনসিপির সদস্য সচিব মঙ্গলবার কমিশনের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের আরও বলেন, বিএনপি ঐকমত্যের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। শুধু তাই নয়, মৌলিক সংস্কারের এজেন্ডাগুলো যেন ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবে না থাকে, তার পরিবেশ তৈরি করছে।
এই বাস্তবতায় এখন প্রশ্ন উঠেছে- সংস্কারের মৌলিক ইস্যুগুলো নিয়ে উদ্ভূত জটিলতার দায়ভার শেষ পর্যন্ত কার কাঁধে বর্তাবে? শুধুই কি রাজনৈতিক দলগুলোই এ অগ্রগতির স্থবিরতার জন্য দায়ী, নাকি দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা তৈরিতে ব্যর্থ হওয়ার দায়ভার গ্রহণ করবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন?
একাধিকবার সংলাপ, আলোচনা ও খসড়া প্রস্তাব সত্ত্বেও নির্ধারিত সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না কবে নাগাদ প্রকাশিত হবে ‘জুলাই সনদ’। রূপরেখা, সময়সীমা এবং প্রস্তাব বাস্তবায়নের কৌশলগত দিকগুলো স্পষ্ট না হওয়ায় সংস্কার কার্যক্রম ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে যেমন প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে, তেমনই কমিশনের কার্যকারিতা নিয়েও তৈরি হয়েছে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও ধোঁয়াশা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ‘কমিশনের বৈঠকে তো রাজনৈতিক দলগুলো একেক কথা বলে। আমি মনে করি, ড. শাহদীন মালিককে বাদ দিয়ে যেদিন ড. আলী রীয়াজকে আনা হয়েছে, সেখানেই প্রথম ভুল করা হয়েছে। এখানে সংস্কার আদৌ হবে কি না সংশয় আছে। এটা হয়তো বিএনপি তখন বুঝতে পারেনি, এখন হয়তো তারা বুঝতে পেরেছে। বাংলাদেশে আপনি সংবিধান সংশোধন করবেন, অথচ যাকে ওই পদে বসিয়েছেন, সংবিধানের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। এভাবে তো সংস্কার হতে পারে না। ’
পিআর পদ্ধতিতে ভোটের প্রস্তাব নিয়ে মুখোমুখি প্রধান দলগুলো সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের প্রস্তাব নিয়ে আগে থেকেই মুখোমুখি অবস্থানে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ কিছু ইসলামী রাজনৈতিক দল। নির্বাচনের তারিখ নিয়েও আগে হয়েছে জলঘোলা পরিস্থিতি। নানা ইস্যুতে গত কয়েক সপ্তাহে দেশের রাজনীতির মাঠ ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আক্রমণ ও কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু হয়েছে ইতোমধ্যেই, যা ঐকমত্য সৃষ্টির প্রক্রিয়াকেও ব্যাহত করতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংস্কারের বিভিন্ন ইস্যু, সংস্কার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এবং সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়েও বেশ কয়েকবার নিজেদের সংশয়ের কথা জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপিসহ বিভিন্ন দল। এসব ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে তাদের মতপার্থক্যও তীব্র হয়ে উঠেছে। দলগুলোর সঙ্গে যখন ঐকমত্য কমিশনের ধারাবাহিক বৈঠক চলছে, তখন এসব মতপার্থক্য জোরালো হয়ে সামনে এসেছে।
দলগুলোর মধ্যে ঐক্য ধরে রাখার তাগিদ
এ মুহূর্তে দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী। এ প্রসঙ্গে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘অভ্যুত্থানের এক বছর যেতে না যেতেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মতানৈক্য তৈরি হয়েছে, তা উদ্বেগজনক। এখন দেশে অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঐক্য প্রয়োজন। সব দলের ঐক্য ছাড়া সংকট ও ষড়যন্ত্র থেকে বের হয়ে আসা যাবে না। দেশে সবাই মিলে একটা ঐক্যের পরিবেশ দরকার। ’
চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতনের পর রাষ্ট্র বিনির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে গত বছর অক্টোবরে গঠিত হয়েছিল ছয়টি সংস্কার কমিশন। প্রথম ধাপে ঘোষিত ছয়টি কমিশনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সংস্কারের প্রক্রিয়া শুরু হলেও, পরবর্তী সময়ে গঠিত আরও কয়েকটি কমিশনের কার্যক্রমও যুক্ত হয় সেই ধারাবাহিকতায়।
পরে গত ফেব্রুয়ারি মাসে কমিশনগুলোর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে গঠন করা হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। চলতি বছর ২০ মার্চ-১৯ মে পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাদা আলাদা আলোচনায় বসে কমিশন। ২ জুন থেকে সব রাজনৈতিক দলগুলোকে একসঙ্গে নিয়ে শুরু হয় কমিশনের দ্বিতীয় দফার আলোচনা পর্ব।
আলোচনার মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে একসঙ্গে একটি ছাতার নিচে আনার চেষ্টা করছে কমিশন। তবে কমিশনের তৈরি করা স্প্রেডশিটে অন্তর্ভুক্ত ১৬৬টি মৌলিক প্রস্তাবের কতগুলো বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হচ্ছে, কিংবা আদৌ সুরাহা পাচ্ছে কি না, অথবা জুলাই সনদও কি ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে তৈরি হবে কি না- তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েই যাচ্ছে।