Image description
অগ্নিঝরা জুলাই

এই কষ্ট কাউকে বুঝানো যায় না। যারা সন্তান হারিয়েছে তারা বুঝবে এই কষ্টটা। এখনো মনে হয় আহাদ চারপাশে ঘুরছে-খেলছে। ছেলেটি সবসময় প্রাণচাঞ্চল্যতায় ঘর মাতিয়ে রাখতো। আমার সন্তান দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। দেশটাকে পুনরায় স্বাধীন করেছে সেটি যেন বৃথা যাচ্ছে। দেশের অস্থিরতা যাচ্ছে না, আমরা এমন অস্থিরতা চাই না, শান্তি চাই। এভাবে কথাগুলো বলছিলেন চার বছরের শিশু শহীদ আব্দুল আহাদের বাবা। তার দুই সন্তানের মধ্যে আহাদ ছিল ছোট। গত বছরের ১৯শে জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গুলিতে মারা যায় সে। আহাদ সেদিন ঘুম থেকে উঠে বাসার অষ্টম তলার বারান্দায় দাঁড়ায়। এ সময় সে দাঁড়িয়ে ছিল তার বাবা-মায়ের মাঝে। হঠাৎ একটি গুলি এসে আহাদের ডান চোখে বিদ্ধ হলে ঢলে পড়ে মেঝেতে।

শহীদ আহাদের বাবা আবুল হাসান মানবজমিনকে বলেন, আহাদকে এ বছর স্কুলে ভর্তি করার কথা ছিল। আমার এগারো বছরের আরেকটি সন্তান রয়েছে সে মাদ্রাসায় পড়ে। পাঁচ মাস ধরে ওই বাসাটিতে ভাড়া থাকতাম। আহাদ যেদিন গুলিবিদ্ধ হয় সেদিন সকালেও আমার বুকের মধ্যে শুয়ে বলেছিল, ‘বাবা তোমার বুকে আমার খুব ভালো লাগে, তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না প্রতিদিন অফিসে নিয়ে যাবা।’ ওর খেলনা গাড়িগুলো খুব পছন্দের ছিল। চিকেন ফ্রাই খেতে খুব ভালোবাসতো। বাইরে নিয়ে গেলে এই পছন্দের জিনিসগুলো কিনে দেয়ার শর্ত দিতো। আমাদের স্বপ্ন ছিল ওর বড় ভাই যখন মাদ্রাসায় পড়ে তখন ওকেও মাদ্রাসায় পড়াবো।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, রায়েরবাগ, মিরাজনগর তিন রাস্তার মোড়ে ভাড়া বাসায় থাকতাম। সেদিন আহাদ ঘুমানো অবস্থায় ছিল। ১১তলা ভবনের ৮ তলায় ভাড়া থাকতাম। বাসার নিচে আন্দোলন চলছিল তখন। সেখানে শিক্ষার্থীরা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ছিল। দু’পক্ষের মধ্যে প্রথম অবস্থায় ইট-পাটকেল ছোড়াছুড়ি চলে। নিচে যখন চিল্লাচিল্লি হচ্ছিল সেই শব্দ কানে গিয়ে আহাদের ঘুম ভেঙে যায়। তখন বিকাল সাড়ে চারটা বাজে। ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে বেলকনির দিকে আসে। তখন আহাদ বলে, ‘বাবা দেখো নিচে মারামারি হচ্ছে।’ ওকে বেলকনিতে আসা দেখে আমি আর আমার স্ত্রী দু’জনেই বেলকনিতে আসি। ও আমাদের দু’জনের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল। এ সময় আচমকা নিচ থেকে হঠাৎ করে একটা গুলি এসে আহাদের ডান চোখে লাগে। পরবর্তীতে তখনই আমরা ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাই। সেখানে চিকিৎসক দেখে তাকে সঙ্গে সঙ্গে আইসিইউতে দেন। ২০শে জুলাই রাত সাড়ে আটটার দিকে আমার সন্তান মারা যায়। ২১শে জুলাই ময়নাতদন্ত শেষে আমাদের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে দাফন করা হয়।
আবুল হাসান বলেন, গুলিটি যখন লাগে তখন আহাদ মেঝেতে ঢলে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে যখন আমরা ধরি তখন আমাদের হাত রক্তে ভিজে যায়। ওইদিনই আরেকজন বয়স্ক লোক নামাজ পড়তে বের হয়ে গুলিতে মারা যান। যে বাসাটায় আমি ভাড়া ছিলাম সেই বাসাটি আহাদ মারা যাওয়ার পর আমরা আর সেখানে যাইনি ছেড়ে দিয়েছি। সন্তান হারানো কষ্টটা কাউকে বুঝানো যায় না। আহাদ ছিল সবার আদরের বেশি চঞ্চল প্রকৃতির থাকায় সবাই তাকে খুব পছন্দ করতো। ওর আম্মু একদম ভেঙে পড়েছে। আমারা যে সম্পদ হারিয়েছি সেটি কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনা করা যায় না। বড় সন্তান দিহান ভাইয়ের জন্য মন খারাপ করে থাকে। আহাদ ছিল দিহানের খেলার সঙ্গী। আমি চাই দেশে আর এমন ঘটনা যেন না ঘটুক। হাজার হাজার মায়ের বুক খালি হয়েছে আর কোনো বাবা-মায়ের বুক যেন খালি না হয়। সাবার আগে দেশে শান্তি চাই।