Image description
এনসিপি’র সমাবেশে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর টহল (বামে), উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সারজিস-হাসনাতদের সাঁজোয়া যানে গোপালগঞ্জ ত্যাগ

দফায় দফায় হামলা-সংঘর্ষ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অ্যাকশনে উত্তপ্ত গোপালগঞ্জ। হামলা-সংঘর্ষের সময় অন্তত ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর আহত হয়েছেন আরও অনেকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রথমে জেলা শহরে ১৪৪ ধারা ও পরে রাত আটটা থেকে পরবর্তী ২২ ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারি করা হয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি’র ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’- কর্মসূচি ঘিরে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়। সারা দেশে পদযাত্রা কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল গোপালগঞ্জে মার্চ টু গোপালগঞ্জ কর্মসূচি পালন করে দলটি। দলের শীর্ষ নেতারা আগের দিন রাতে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে এই কর্মসূচির প্রচারণা   চালান। এতে রাত থেকেই উদ্বেগ তৈরি হয়। কর্মসূচি ঘিরে সকাল থেকেই গোপালগঞ্জে উত্তেজনা দেখা দেয়। সকালে পুলিশের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়িতে হামলা চালানো হয়। এনসিপি নেতাদের সম্ভাব্য প্রবেশ পথে গাছ কেটে অবরোধ তৈরি করা হয়। বাধা এড়িয়ে শহরে নেতারা পৌঁছার আগেই পৌর পার্কের সমাবেশ স্থলে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালায়। তারা মঞ্চ ও চেয়ার ভাঙচুর করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধাওয়ায় সটকে পড়ে। পরে সমাবেশস্থলে পৌঁছান এনসিপি নেতারা। সেখানে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ শেষ করে ফেরার পথে ফের হামলা হয় তাদের গাড়িবহরে। ব্যাপক এই হামলার পর এনসিপি নেতাদের সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। হামলা ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে দফায় দফায় চলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ। দফায় দফায় চলা সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় জেলা শহর। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দুপুরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। বিকালে  ঘোষণা করা হয় রাত আটটা থেকে আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত কারফিউ জারি থাকবে। হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সরকারের তরফে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে এতে জড়িত কেউ ছাড় পাবে না। 

বিএনপি এই হামলাকে ন্যক্কারজন উল্লেখ করে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এই হামলার ঘটনার নিন্দা জানানো হয়েছে। ঘটনার প্রতিবাদে সারা দেশে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে এনসিপিসহ বিভিন্ন সংগঠন। 

যেভাবে সংঘর্ষের সূত্রপাত: এনসিপি’র ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ দিন-তারিখ ঠিক হওয়ার পর বেশ কয়েকদিন ধরে আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গোপালগঞ্জে তাদের কর্মসূচি প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার রাতে জেলার বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা মশাল মিছিল করে ফেসবুকে প্রচার করে। গতকাল সকাল পৌনে ৯টার দিকে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার উলপুর ইউনিয়নের খাটিয়াগড় এলাকায় পুলিশের টহল গাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। এ সময় বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন। সকাল ১০টার দিকে গোপালগঞ্জ সদরের বৌলতলী ইউনিয়নের কংসুর বাসস্ট্যান্ডে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও)’র গাড়িবহরে হামলা হয়। এতে ইউএনও’র গাড়িচালক আহত হন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা গোপালগঞ্জ-কোটাপাড়া সড়কে গাছ ফেলে অবরোধ করে। এ সময় ওই সড়কে সকল ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। 

যেভাবে সমাবেশে হামলা: বেলা পৌনে ২টার দিকে ২০০ থেকে ৩০০ লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে এনসিপি’র সমাবেশস্থলে যায়। ওই সময় মঞ্চের আশপাশে থাকা পুলিশ সদস্যরা সেখান থেকে দ্রুত আদালত চত্বরে ঢুকে পড়েন। একই সময়ে মঞ্চে ও মঞ্চের সামনে থাকা এনসিপি’র নেতাকর্মীরাও দৌড়ে সরে যান। হামলাকারীরা সবাই আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে এনসিপি’র নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেন। হামলাকারীরা মঞ্চের চেয়ার ভাঙচুর করে, ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে। একপর্যায়ে জেলা পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান ঘটনাস্থলে যান। এ সময় এনসিপি’র নেতাকর্মী ও পুলিশ এক হয়ে ধাওয়া দিলে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। বেলা ২টা ৫ মিনিটে সমাবেশস্থলে পৌঁছান এনসিপি’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। সেখানে শান্তিপূর্ণভাবেই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। 
সমাবেশ শেষে ফিরে যাওয়ার সময় হামলার মুখে পড়ে এনসিপি’র কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের গাড়িবহর। শহরের সমাবেশস্থল থেকে বের হওয়ার পথেই কেন্দ্রীয় নেতাদের বহনকারী গাড়িবহরের ওপর ব্যাপক ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ফাঁকা গুলি ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে পুলিশ। পুলিশ ও র?্যাবের পাহারায় এনসিপি’র নেতাদের শহর থেকে বাইরে বের করার চেষ্টা করা হলেও ব্যাপক হামলার মুখে তাদের আবার শহরে ফিরিয়ে আনা হয়। কিছুক্ষণ পরে সেনাবাহিনীর টহল টিম সেখানে এলে তারাও হামলার মুখে পড়ে। পরে এনসিপি’র নেতাকর্মীরা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের কম্পাউন্ডের ভেতরে আশ্রয় নেন। বিকাল ৪টার দিকে সেনাবাহিনীর গাড়িতে করে গোপালগঞ্জ থেকে সরিয়ে নেয়া হয় নেতাকর্মীদের। গোপালগঞ্জ থেকে এনসিপি নেতাদের কড়া পাহারায় খুলনা সার্কিট হাউজে পৌঁছে দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। 

সংঘর্ষে নিহত ৪: এনসিপি’র সমাবেশ ঘিরে হামলা ও সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়েছেন। হাসপাতাল ও নিহতদের পরিবার সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। 
নিহতদের মধ্যে আছেন, শহরের উদয়ন রোডের সন্তোষ সাহার ছেলে দীপ্ত সাহা (৩০), কোটালিপাড়ার হরিণাহাটি গ্রামের কামরুল কাজীর ছেলে রমজান কাজী (১৯), শানাপাড়ার সোহেল রানা (৩৫) এবং সদর উপজেলার ভেড়ার বাজার এলাকার ইমন। গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জীবিতেষ বিশ্বাস রাতে মানবজমিনকে বলেন, এখন পর্যন্ত চারজনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। তাদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। সংঘর্ষের ঘটনায় আহত অনেকে চিকিৎসা নিলেও তাদের সঠিক সংখ্যা এখনো জানা যায়নি। নিহতদের বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। 

গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারে হামলা: এনসিপি’র সমাবেশকে ঘিরে সৃষ্ট সংঘর্ষের মধ্যে গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। বিকাল ৪টার দিকে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এতে বেশ কয়েকজন কারারক্ষী আহত হন। হামলার খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায় সেনাবাহিনী ও পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিকাল ৪টার দিকে কয়েকশ’ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী আচমকা জেলা কারাগারে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এতে কারাগারের জানালার গ্লাস ভেঙে যায়। খবর পেয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে অ্যাকশনে গেলে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। 

মুজিববাদীরা বাধা দিয়েছে, জবাব দেয়া হবে: নাহিদ
ওদিকে গোপালগঞ্জের পদযাত্রা ও সমাবেশে ‘মুজিববাদীরা’ বাধা দিয়েছে, তার জবাব দেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। দফায় দফায় হামলা ও ভাঙচুরের পর গোপালগঞ্জ শহরের পৌরপার্ক এলাকায় সমাবেশ মঞ্চে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে তিনি এ হুঁশিয়ারি দেন। তিনি বলেন, ‘মুজিববাদীরা’ আজকে বাধা দিয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে আমরা বলেছিলাম, বাধা দিলে বাঁধবে লড়াই, সেই লড়াইয়ে জিততে হবে। এবং সেই লড়াইয়ে আমরা জিতেছিলাম। আজকে আমাদের বাধা দেয়া হয়েছে। অচিরেই আমরা এর জবাব দেবো ইনশাআল্লাহ। নাহিদ বলেন, ‘যারা গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষে, নতুন বাংলাদেশের পক্ষে তাদের দায়িত্ব নিতে হবে। এই গোপালগঞ্জ যেন আর ‘মুজিববাদী’দের কেন্দ্র হয়ে উঠতে না পারে। যদি পুলিশ দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়, নিজেদের জেলার মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব, বাংলাদেশকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে। যেমন আমরা গণ-অভ্যুত্থানে নিয়েছিলাম। 

এনসিপি নেতা বলেন, আমরা ঘোষণা দিলে সারা বাংলাদেশ এই গোপালগঞ্জে এসে জড়ো হবে। কিন্তু আমরা সময় দিয়ে যাচ্ছি। আজকে যে হামলা হলো, কোন সাহসে বাধা দেয়া হয়েছে, কোন সাহসে ‘মুজিববাদীরা’ গোপালগঞ্জে এখনো আশ্রিত হয়ে আছে, কারা আশ্রয় দিয়েছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে যদি এর সামধান না হয়, তাহলে আমরা আবারো আসবো গোপালগঞ্জে। আমরা নিজ হাতে দায়িত্ব নিয়ে গোপালগঞ্জকে ‘মুজিববাদী’দের হাত থেকে মুক্ত করবো ইনশাআল্লাহ। মুজিববাদীদের কবর রচনা করে, বাহাত্তরের সংবিধানের কবর রচনা করে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলবো, এটা আমাদের আপনাদের কাছে ওয়াদা।

আল্টিমেটাম: গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গোপালগঞ্জসহ সারা দেশে ‘আওয়ামী সন্ত্রাসীদের’ গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ ছাড়া অবিলম্বে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ জারির দাবি তুলেছে সংগঠনটি। বুধবার রাজধানীর শাহবাগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটি এই দাবিসহ তিন দফা দাবি জানায়। সরকার এসব দাবি না মানলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সংগঠনটির সভাপতি রিফাত রশিদ। তিনি বলেন, গোপালগঞ্জে যা শুরু হয়েছে, সেখানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা এবং দিল্লি, এদের চক্রান্তে গোপালগঞ্জের মধ্যে একটি প্রক্সি স্টেট কায়েম করেছে। সেখানকার সার্বভৌমত্ব নিয়ন্ত্রণ করছে স্বৈরাচারী হাসিনা এবং দিল্লির মসনদে বসে থাকা ওই লুটেরারা, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সার্বভৌমত্বকে সবসময় ছিনিয়ে নিতে চায়। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, এই প্রক্সি স্টেট খেলা আমরা হতে দিবো না। সংগঠনের তরফে তিন দফা দাবি তুলে ধরেন তিনি। দাবিগুলো হচ্ছে- অবিলম্বে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ জারি করতে হবে। ‘আওয়ামী পুলিশি’ কাঠামো ভেঙে ফেলে পুরো ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গোপালগঞ্জসহ সারা দেশে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে সক্রিয় সকল আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করতে হবে।

বৈষম্যবিরোধীদের এসব দাবি সরকার মেনে না নিলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন রিফাত রশিদ।