
বাংলাদেশে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়েমা ওয়াজেদ পুতুলকে ঘিরে দেশের মানুষের কৌতূহলের অন্ত নেই। আমি সেটা টের পেয়েছিলাম ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে, যখন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে আমার একটি কলাম প্রকাশিত হয়—যার শিরোনাম ছিল: ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিয়ে শেখ হাসিনার পুতুল খেলা’। প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে লেখাটি বিডিনিউজের ফেইসবুক পেইজ থেকে তিন হাজারের বেশি বার শেয়ার হয় এবং মন্তব্যের ঝড় বইয়ে যায়; কেউ কেউ পুতুল ও তার মায়ের সমর্থনে মন্তব্য করলেও, সমালোচনা, বলা ভালো নিন্দার সংখ্যাই ছিল বেশি।
সে লেখায় আমি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছিলাম—বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক পদে সায়েমা ওয়াজেদ পুতুলের প্রার্থিতা বৈধ করার জন্য কী কী অবৈধ পন্থা অবলম্বন করা হয়েছিল। তার জীবন-বৃত্তান্তে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা এবং নির্বাচনের প্রক্রিয়াটির অনিয়ম নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা ছিল সেখানে। আমি স্পষ্টভাবে লিখেছিলাম, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের ছয় শ’ মিলিয়ন ডলারের বাৎসরিক বাজেট পরিচালনা ও ১১টি দেশের দুইশ’ কোটির মতো মানুষের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনার জন্য সায়েমা ওয়াজেদ পুতুলের কোনো প্রয়োজনীয় যোগ্যতাই নেই।
আরেকটি বিষয়ে লেখাটিতে বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছিল—সায়েমা ওয়াজেদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে থাকায় বাংলাদেশ সরকারকে কীভাবে সংস্থাটির সেবা পেতে নানাবিধ অসঙ্গত ও অসমর্থনযোগ্য সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছিল তখন। সেখানে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, এই পদে একজন যোগ্য ব্যক্তি থাকা একান্ত প্রয়োজন, তিনি যে কোনো দেশেরই হোন না কেন। তাহলে বাংলাদেশ সরকার কি সায়েমা ওয়াজেদকে প্রত্যাহার করতে পারবে?
এর ঠিক এক মাস পর, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে, বাংলাদেশ সরকারের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পুতুলের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে।
এরই ধারাবাহিকতায় দুদক সায়েমা ওয়াজেদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করে এবং পরে একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় উল্লেখ করা হয়—আঞ্চলিক পরিচালক হওয়ার প্রচারে সায়েমা ওয়াজেদ তার শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। যা বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ৪৬৮ ধারা (প্রতারণার উদ্দেশ্যে জালিয়াতি) এবং ৪৭১ ধারা (জাল দলিল ব্যবহার) অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
আরও অভিযোগ ওঠে, তিনি ‘সূচনা ফাউন্ডেশন’ নামে একটি দাতব্য সংস্থা গঠন করে এর প্রধান হিসেবে নিজের রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ২.৮ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ২৮ লাখ মার্কিন ডলার) সংগ্রহ করেছেন এবং সেই অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের একটি আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
দুদকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় যৌথভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে (ডব্লিউএইচও) একটি চিঠি পাঠায়। সেই চিঠিতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়েমা ওয়াজেদকে আঞ্চলিক পরিচালক পদ থেকে অপসারণের অনুরোধ জানানো হয়।
দুদকের পক্ষ থেকে আরও অভিযোগ তোলা হয়—সায়েমা ওয়াজেদ কানাডার নাগরিকত্ব বজায় রেখে নিজেকে শুধুমাত্র বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে মিথ্যাভাবে উপস্থাপন করেছেন, যা তার ডব্লিউএইচও-তে পদলাভের ক্ষেত্রে প্রতারণার সামিল।
বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দিলেও তখন ধারণা করা হচ্ছিল, মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সায়েমা ওয়াজেদকে ওই পদ থেকে অপসারণ করা সহজ হবে না। কারণ, একদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঢিলেঢালা কার্যক্রম, অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সায়েমা ওয়াজেদের প্রতি নিঃশর্ত ও অটল সমর্থন—এই দুই বিষয়ই ছিল অপসারণের পথে বড় প্রতিবন্ধক।
শেষ পর্যন্ত শেষ রক্ষা হলো না সায়েমা ওয়াজেদের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাকে দীর্ঘ ছুটিতে পাঠিয়েছে, যা প্রকারান্তরে চাকরিচ্যুত করাই বোঝায়। অভিযোগগুলো এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, সংস্থাটির পক্ষে তা দীর্ঘদিন উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিষয়ক পর্যবেক্ষক সংস্থা হেলথ ওয়াচ গ্রুপ এক বিবৃতিতে জানায়, “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আঞ্চলিক কার্যালয়ের বিতর্কিত আঞ্চলিক পরিচালক সায়মা ওয়াজেদকে ১১ জুলাই ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত এসেছে বাংলাদেশে দুদক দায়ের করা জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের দুটি মামলার চার মাস পর।”
সংস্থাটি আরও জানায়, “অভিযোগ গঠনের পর বাংলাদেশের আদালত সায়েমা ওয়াজেদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এর ফলে ডব্লিউএইচও-এর বাংলাদেশ অফিস তার সঙ্গে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়। পাশাপাশি গ্রেপ্তারি পরোয়ানার পর সায়মা ওয়াজেদ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোতে নির্বিঘ্নে ভ্রমণও করতে পারছিলেন না।”
স্বাস্থ্য খাতে সায়েমা ওয়াজেদের অভিজ্ঞতা এতটাই সীমিত ছিল যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাজে তার তেমন কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি—এ কথা বলা বাহুল্য। বরং তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন সংস্থাটির কোনো কার্যকর সেবা পায়নি বা গ্রহণ করতে পারেনি। এটি নিঃসন্দেহে দেশের জন্য এক বড় ধরনের নেতিবাচকতা।
কয়েক মাস আগে ইন্দোনেশিয়া সরকার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চল থেকে নিজেদের সদস্যপদ পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পুনঃনির্ধারণের জন্য আবেদন করে। চলতি বছরের মে মাসে সেই আবেদন গৃহীত হয়েছে। আমি নিশ্চিত করে বলছি না যে, শুধুমাত্র সায়েমা ওয়াজেদের কারণেই ইন্দোনেশিয়া এই অঞ্চল ত্যাগ করেছে। কিন্তু কোনো আঞ্চলিক পরিচালকের জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি ব্যর্থতা—তিনি তার অধীন অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন।
সায়েমা ওয়াজেদকে ঘিরে শেখ হাসিনার একধরনের মোহ অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষককে বিস্মিত করেছে। তাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক পদে বসাতে শেখ হাসিনা এমন কোনো হাতিয়ার নেই যা ব্যবহার করেননি। এই প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পদ ও জনবল ব্যবহৃত হয়েছে। পাশাপাশি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সম্পর্ককেও একটি কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছে।
সায়েমা ওয়াজেদ পুতুলকে ঘিরে শেখ হাসিনার যে আচ্ছন্নতা বা 'অবসেশন', তা পুরোপুরি বুঝতে হলে আগে বোঝা দরকার তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে জন্ম নেওয়া হতাশার প্রেক্ষাপট। বহু বছর ধরে শেখ হাসিনা চেষ্টা করেছেন জয়কে আওয়ামী লীগের উত্তরসূরি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু যতদূর জানা যায়, জয় শুরু থেকেই রাজনীতিতে অনাগ্রহের কথা মাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি পশ্চিমা বিশ্বে বসবাস করছেন—সম্ভবত তার রাজনৈতিক মানসিকতা এবং রাষ্ট্রচিন্তার ধরন সেখানে তৈরি হওয়ায় তা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে আলাদা।
সম্ভবত জয় শুরু থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন, শেখ হাসিনার ক্ষমতা-কেন্দ্রিক রাজনৈতিক মডেল দীর্ঘস্থায়ী নয়। আব্রাহাম লিংকনের সেই বিখ্যাত উক্তি, যা আজও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে উদ্ধৃত হয়—“তুমি কিছু সময় সব মানুষকে বোকা বানাতে পারো, আর কিছু মানুষকে সব সময়, কিন্তু তুমি সব সময় সব মানুষকে বোকা বানাতে পারবে না।” (You can fool all the people some of the time, and some of the people all the time, but you cannot fool all the people all the time.) জয়ের মনোভাব ও অবস্থান বুঝতে এই উক্তিটি যথাযথ।
শেখ হাসিনার পতনের প্রায় দুই বছর আগে থেকেই সজীব ওয়াজেদ জয় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেন। সেই সময় থেকেই হাসিনা বিকল্প খুঁজতে শুরু করেন এবং মেয়ে সায়েমা ওয়াজেদ পুতুল নিজের উত্তরাধিকার হিসেবে প্রস্তুত করার পরিকল্পনা আঁটেন বলে ধারণা করা হয়।
তার লক্ষ্য ছিল, মেয়ের জন্য এমন একটি ‘গর্ব করার মতো প্রোফাইল’ গড়ে তোলা, যা তাকে শুধু শেখ হাসিনা ও এম এ ওয়াজেদ মিয়ার কন্যা হিসেবে নয়, একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একাডেমিক ও নীতিনির্ধারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক পদ তার সেই পরিকল্পনারই অংশ ছিল—যার মাধ্যমে সায়েমা ওয়াজেদ পুতুল ভবিষ্যতে আওয়ামী রাজনীতিতে একটি ব্যক্তিত্বময় অবস্থান তৈরি করতে পারবেন, এমনটাই ছিল শেখ হাসিনার কল্পনা ও আশা।
সায়েমা ওয়াজেদের জন্য বিশেষভাবে একটি ডক্টরেট ডিগ্রির ব্যবস্থা করা হয়েছিল, অটিজম বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল এবং পাশাপাশি তাকে আঞ্চলিক প্রধানের পদেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ধারণা করা হয়েছিল, এগুলো ভবিষ্যতে রাজনীতির ক্ষেত্রেও কাজে লাগবে। কিন্তু একের পর এক মা-মেয়ের স্বপ্নের সব দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
আমি ব্যক্তিগতভাবে এই বিষয়ে আনন্দিত যে অবশেষে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আঞ্চলিক অফিসে একজন প্রকৃত স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে পরিচালক হিসেবে দেখা যাবে। এর ফলে বাংলাদেশও অন্যান্য দেশের মতো স্বাভাবিকভাবে সংস্থার সেবা গ্রহণ করতে পারবে।
তবে সায়েমা ওয়াজেদের চাকরি হারানোতে আনন্দের কিছু নেই—কারণ আমারও তার বয়সি একটি মেয়ে আছে। সে নিউ ইয়র্কের একটি প্রতিষ্ঠানে নিজের পছন্দমতো কাজ করছে। আমি সর্বদা চাই সে তার কাজের ধারাবাহিকতাই ধরে রাখুক এবং এগিয়ে যাক।
সায়েমা ওয়াজেদ পুতুলও মায়ের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে নিশ্চয়ই নিজের পছন্দমতো পথ বেছে নিতে পারবেন। আশা করি, একদিন তিনি বুঝতে পারবেন—‘ধার করা ক্ষমতা’ অনেক আনন্দকে মাটিতে ফেলে দেয় আর ক্ষমতাহীন জীবনেও অনেক আনন্দ লুকিয়ে থাকে।