
তখন বেলা তিনটা। দুপুরের খাবার খেয়ে নিজের দোকানের ভেতরে বসে ছিলেন মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। দরজা ছিল পুরোপুরি আটকানো। হঠাৎ ককটেল বিস্ফোরণের শব্দে আঁতকে ওঠেন তিনি। ভয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে পড়েন। এরপরের প্রায় তিন ঘণ্টায় গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাসের শেলে কেঁপে ওঠে তাঁর দোকানসহ পুরো এলাকা। অন্তত তিনজনকে গুলি ছুড়তে দেখেন চল্লিশোর্ধ্ব এ ব্যবসায়ী।
চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর মোড়ের সিরাজ শপিং কমপ্লেক্সের নিচতলায় মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান—সৈয়দ অটো পার্টস। আজ থেকে ঠিক এক বছর আগের এই দিনে (গত বছরের ১৬ জুলাই) মুরাদপুর এলাকা যেন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। রক্ত ঝরেছিল আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের। প্রাণ হারিয়েছিলেন তিনজন।
সেদিন পূর্বঘোষণা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর স্টেশনে বিক্ষোভ কর্মসূচি করার কথা ছিল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের। বেলা সাড়ে তিনটায় এ কর্মসূচি শুরুর আগেই স্টেশনে অবস্থান নেন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। পরে আন্দোলনকারীরা খণ্ড খণ্ড জমায়েতে স্টেশনের দিকে আসতে থাকেন। শুরু হয় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। একপর্যায়ে বেলা তিনটার দিকে মুরাদপুর মোড়ে জড়ো হন আন্দোলনকারীরা। হামলা ছড়িয়ে পড়ে সেখানেও।
সেদিনকার ঘটনা খুব কাছ থেকেই প্রত্যক্ষ করেন ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি দেখলেন, হু হু করে শিক্ষার্থীরা মোড়ে এসে দাঁড়ালেন। মুহূর্তেই চট্টগ্রাম-হাটহাজারী সড়ক, মির্জারপুল সড়ক, বহদ্দারহাট সড়ক জনসমুদ্রে পরিণত হলো। অন্যদিকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও বিভিন্ন অলিগলিতে অবস্থান নেন। শুরু হয় হামলা, গোলাগুলি।
সেই মুহূর্তের কথা মনে পড়লে এখনো ভয়ে আঁতকে ওঠেন মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্দোলন শুরু হওয়ার পরপরই দোকানের দরজা টেনে দিই। কিন্তু ঘটনাস্থল ছেড়ে যাইনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই হামলা শুরু হয়। আমরা ভয়ে নিশ্চুপ হয়ে বসে ছিলাম।’
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘সেদিন আমার চোখের সামনেই অন্তত তিন ব্যক্তি শিক্ষার্থীদের দিকে গুলি ছুড়েছে। গুলি ছুড়তে ছুড়তে মোড়ের দিকে আসতে থাকে হেলমেট পরা ব্যক্তিরা। তখন আমরা মোড়ের এক পাশে ছিলাম। হঠাৎ দেখি, একজন আন্দোলনকারী পেটে হাত দিয়ে বসে পড়েছেন। রক্তে তাঁর শার্টটা ভিজে গেল। পরে জেনেছি, গুলিবিদ্ধ হয়ে ওই আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয়েছে।’
২০০৫ সাল থেকে চট্টগ্রামে ব্যবসা পরিচালনা করছেন রাউজানের নোয়াপাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। নগরের চান্দগাঁও এলাকায় একটা ভাড়া বাসায় থাকেন পরিবার নিয়ে। আন্দোলনের এক বছর উপলক্ষে তাঁর সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তিনি বলেন, ‘হেলমেটধারীরা যখন গুলি ছুড়ছিল, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নীরব ভূমিকায় ছিলেন। আশপাশের দোকানিরা দরজা লাগিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যান। কেউ কেউ ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। আগে কখনো এত তীব্র আন্দোলন দেখিনি।’
১৬ জুলাইয়ের ঘটনার বিষয়ে মুরাদপুর মোড়ের ১০ জন দোকানির সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের মধ্যে ৯ জন বলেন, হামলা শুরু হওয়ার পর দোকান বন্ধ করে তাঁরা নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়েছিলেন। দিনটা এত সংঘাতময় ছিল যে তাঁরা মুরাদপুরে থাকার সাহস করেননি।
‘ভয় পেয়েছিলাম, তবে পিছু হটিনি’
বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নিতে সেদিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ক্যাম্পাস থেকে শহরের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমাইয়া শিকদার। মুরাদপুর এলাকায় এসে তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে খবর পান, ষোলশহরে জড়ো হয়েছেন ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতা-কর্মীরা। এরপর কী করেছিলেন, তা শোনা যাক সুমাইয়ার কণ্ঠে।
সুমাইয়া বলেন, ‘বেলা তিনটার দিকে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। পরে আরও কয়েকজনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য আমরা বিবিরহাট এলাকার দিকে চলে যাই। বিভিন্ন মোড়ে সেদিন রামদা হাতে দাঁড়িয়ে ছিল হেলমেট পরা ব্যক্তিরা। বিবিরহাটে আরও কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়। একপর্যায়ে আমরা চলে আসি মুরাদপুর মোড়ে।’
মোড়ে এসে কোটার বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দিতে থাকেন সুমাইয়া শিকদার। তখন বিকেল চারটা। তাঁর ভাষ্য, ‘সেদিন হামলা শুরুর পর বহদ্দারহাট থেকে জিইসি যাওয়ার সিডিএ অ্যাভিনিউ সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আতঙ্কিত হয়ে সাধারণ মানুষ এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। ষোলশহর, শুলকবহর, মির্জারপুল সড়কে অবস্থান নেয় যুবলীগ ও নগর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। তারা গুলি, ইটপাটকেল ছুড়ছিল। আমরা ভয় পেয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু পিছু হটিনি।’
সুমাইয়া বলেন, ‘আমার পাশেই এক ভাই স্লোগান দিচ্ছিলেন। হঠাৎ ওই ভাইয়ের গায়ে কয়েকটা ছররা গুলি এসে পড়ে। পরে এক পাশে বসিয়ে রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবকেরা ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পর দেখলাম ষোলশহরের দিক থেকে একটা ভাই দৌড়ে আসছেন। তাঁর মাথা থেকে রক্ত বেয়ে পড়ছিল।’
সেদিন ভবনের ওপর থেকেও পাথর ছুড়েছিল। এ ঘটনাও প্রত্যক্ষ করেছিলেন সুমাইয়া। তিনি বলেন, ‘মোড়ের পাশে একটা ভবনের ওপর থেকে পাথর ছোড়া হচ্ছিল। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা সেই ভবনে উঠে পাথর নিক্ষেপকারীদের নামিয়ে আনেন। মারধরও করা হয়।’
মোড়ে সংঘর্ষ চলে সন্ধ্যা প্রায় সাতটা পর্যন্ত। সুমাইয়া তাঁর বন্ধুদের নিয়ে আবার ক্যাম্পাসে ফিরে যান। তবে নিরাপত্তাহীনতায় হলে থাকেননি। ক্যাম্পাসের ২ নম্বর গেটের একটি বাসায় আশ্রয় নেন।

সেদিন শুরু থেকেই ঘটনাস্থলে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী জোবাইরুল আরিফ। তিনি বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টি চট্টগ্রামের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করছেন। আরিফ জানান, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা সেদিন আন্দোলনকারীদের ওপর অবর্ণনীয় হামলা চালিয়েছিলেন। সেদিন যাঁকে যেখানে পেয়েছিলেন, সেখানেই আঘাত করা হয়। তিন দিক থেকে হামলা চালিয়ে আন্দোলনকারীদের দমানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু মুরাদপুর মোড় ছেড়ে কেউ যাননি। আরিফ বলেন, ‘খুব কাছ থেকেই গুলি ছোড়া হয়েছে। পুলিশও গুলি ছুড়েছে। আমাদের ওই সমন্বিত শক্তির বিপক্ষে লড়াই করতে হয়েছে।’
একাধিক মামলা, গ্রেপ্তার
সেদিন আন্দোলন চলাকালে প্রাণ হারিয়েছিলেন মোহাম্মদ ফারুক (৩২), মো. ওয়াসিম আকরাম (২২) ও ফয়সাল আহমেদ (২০)। ফারুক ছিলেন আসবাবের দোকানের কর্মচারী। ওয়াসিম চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র ও কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক, ফয়সাল ওমর গণি এমইএস কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী। এ ছাড়া আহত হয়েছিলেন অর্ধশতাধিক।
এ ঘটনায় তিনটি মামলা হয়েছে। মামলায় শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, হাছান মাহমুদ, মহিবুল হাসান চৌধুরী, আ জ ম নাছির উদ্দিনসহ ৫০৪ জন আসামি আছেন। পুলিশ সূত্র জানায়, এসব মামলায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তদন্ত চলছে। শিগগিরই কয়েকটি মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হবে।