Image description

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় পুলিশের গুলিতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে রাজধানী ঢাকায়। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও রামপুরা—শুধু এই পাঁচ এলাকাতে নিহত হয়েছেন অন্তত ৩২৪ জন।

প্রাণহানির এই চিত্রই বলে দিচ্ছে গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর পরিস্থিতি কতটা ভয়ংকর ছিল। প্রথম আলোর হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত মাত্র ২১ দিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ৪২৬ জন।

গণ–অভ্যুত্থানের পুরোটা সময় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আক্রমণাত্মক ছিলেন। নির্বিচার গুলিতে তখন যাত্রাবাড়ীতে নিহত হন ১১৭ জন, উত্তরায় ৭০ জন, মিরপুরে ৬২ জন, মোহাম্মদপুরে ৪৩ জন ও রামপুরায় ৩২ জন। এর বাইরে বাড্ডা, ভাটারা, নিউমার্কেট, বংশালসহ রাজধানীর ২২টি এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে ১০২ জনের।

রাজধানীর বাইরে সাভার, চট্টগ্রাম, নরসিংদী, ফেনী ও রংপুরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ব্যাপক মাত্রায় বলপ্রয়োগ করা হয়েছিল। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ছাত্র–জনতার ৩৬ দিনের (১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট) আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ১৮, ১৯ ও ২০ জুলাই এবং ৪ ও ৫ আগস্টে। এর মধ্যে ১৮ জুলাই ৫৩ জন, ১৯ জুলাই ১৭৭ জন, ২০ জুলাই ৬৫ জন, ৪ আগস্ট ১০৮ জন এবং ৫ আগস্ট ৩৪৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ এই পাঁচ দিনেই মৃত্যু হয়েছে ৭৪৭ জনের।

নির্বিচার গুলিতে তখন যাত্রাবাড়ীতে নিহত হন ১১৭ জন, উত্তরায় ৭০ জন, মিরপুরে ৬২ জন, মোহাম্মদপুরে ৪৩ জন ও রামপুরায় ৩২ জন। এর বাইরে বাড্ডা, ভাটারা, নিউমার্কেট, বংশালসহ রাজধানীর ২২টি এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে ১০২ জনের।

সরকারি গেজেট অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন ৮৪৪ জন। এর মধ্যে ৮০২ জনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করেছে প্রথম আলো। এই ৮০২ জনের মধ্যে ৭০৬ জনের মৃত্যু হয়েছে গুলিতে। অর্থাৎ ৮৮ শতাংশই মারা গেছেন গুলিতে। অধিকাংশেরই গুলি লেগেছিল বুকে, পিঠে ও মাথায়। ওই সময়ে বাসাবাড়িও নিরাপদ ছিল না। বাসাবাড়িতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নারী–শিশুসহ ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবি প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছিল, যা জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। পুলিশের পাশাপাশি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের (এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ) বিভিন্ন সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের অনেক নেতা-কর্মীকে গুলি করতে দেখা গেছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় গত ফেব্রুয়ারি মাসে। এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, শেখ হাসিনার সরকার ক্রমাগত নৃশংস পদক্ষেপ নিয়ে পদ্ধতিগতভাবে বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করেছিল। ওই সময়ে (১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে) ১ হাজার ৪০০ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিক্ষোভ চলাকালে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৬৬ শতাংশ মিলিটারি রাইফেলসে (এমন অস্ত্র সশস্ত্র বাহিনী ব্যবহার করে), ১২ শতাংশ শটগানের গুলিতে এবং ২ শতাংশ পিস্তলের গুলিতে প্রাণ হারান।

সরকারি গেজেট অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন ৮৪৪ জন। এর মধ্যে ৮০২ জনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করেছে প্রথম আলো। এই ৮০২ জনের মধ্যে ৭০৬ জনের মৃত্যু হয়েছে গুলিতে। অর্থাৎ ৮৮ শতাংশই মারা গেছেন গুলিতে।

যাত্রাবাড়ী যেন ‘মৃত্যুপুরী’

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায়। গত বছরের ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট (আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন) পর্যন্ত যাত্রাবাড়ীতে অন্তত ১১৭ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে শুধু ৫ আগস্ট নিহত হন ৫৬ জন। এ ছাড়া ১৯ জুলাই ১৯ জন এবং ২০ জুলাই ১৫ জনের মৃত্যু হয়।

গত বছরের ১৮ জুলাই থেকে যাত্রাবাড়ী এলাকা কার্যত অচল করে দেন আন্দোলনকারীরা। ২১ জুলাই পর্যন্ত টানা চার দিন এবং ৪ ও ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানার সামনে থেকে শুরু করে কাজলা, শনির আখড়া, নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দখলে ছিল আন্দোলনকারীদের।

আন্দোলনকারীদের সড়ক থেকে সরিয়ে দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং তৎকালীন সরকার সমর্থকেরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মাঠে ছিলেন। শুরু থেকেই যাত্রাবাড়ীর আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন শিক্ষার্থী তানভীর আহমেদ (তখন একটি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়তেন) ও তাঁর বাবা আসবাব পণ্যের দোকানের কর্মী আবদুর হান্নান। ৫ আগস্ট পুলিশের গুলিতে মারা যান আবদুর হান্নান।

তানভীর আহমেদ গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, পুরো যাত্রাবাড়ী অঞ্চলের পরিস্থিতি তখন ভয়াবহ ছিল। যাত্রাবাড়ী মৃত্যুপুরী হয়ে উঠেছিল। পুলিশ নির্বিচার গুলি করত। গুলি থেকে বাঁচতে কখনো সড়ক বিভাজকের পাশে শুয়ে, আবার কখনো পিলারের পেছনে লুকিয়ে থাকতেন তাঁরা। বহু মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। কিন্তু গুলির মধ্যেও তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে গেছেন, সড়কে বিক্ষোভ করেছেন।

পুলিশের পাশাপাশি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের (এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ) বিভিন্ন সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের অনেক নেতা-কর্মীকে গুলি করতে দেখা গেছে।

তানভীর আহমেদ বলেন, ‘৫ আগস্ট বেলা সাড়ে তিনটার দিকে কাজলা এলাকায় আমরা বিজয় উদ্‌যাপন করছিলাম। তখন বাবার ফোন থেকে একজন ফোন করে জানান, যাত্রাবাড়ী থানার পেছনে বাবার মাথায় গুলি লেগেছে। দৌড়ে গিয়ে দেখি লাশ পড়ে আছে। আশপাশে কেউ নেই। তখন কয়েকজন স্বজন ও বন্ধু মিলে বাবার লাশ ভ্যানে তুলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। কখনো ভাবিনি চূড়ান্ত বিজয়ের পর বাবার লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে।’

যাত্রাবাড়ী এবং নারায়ণগঞ্জে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক মাদ্রাসার ছাত্রদেরও আন্দোলনে অংশ নিতে দেখা গেছে। মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণেও দেখা গেছে, অনেক মাদ্রাসাশিক্ষার্থী মারা গেছেন যাত্রাবাড়ী–নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলে।

যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশ নির্বিচার গুলি করেছে, এমন অনেকে ভিডিও আন্দোলন চলার সময়েই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, একের পর এক গুলি করছে একদল পুলিশ। যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই গুলি করছে। ওই ভিডিওটি ৫ আগস্টের।

অন্য একটি ভিডিওতে (২০ জুলাই) দেখা যায়, একদম কাছ থেকে পুলিশ এক তরুণকে গুলি করছে। গুলিবিদ্ধ তরুণের সঙ্গে আরেকজন ছিলেন। গুলিবিদ্ধ ওই তরুণকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন তিনি। পুলিশের আক্রমণের মুখে একপর্যায়ে ওই ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ তরুণকে ছেড়ে দৌড়ে চলে যান। পুলিশ তখনো গুলি করছিল। পরে জানা যায়, গুলিবিদ্ধ তরুণের নাম ইমাম হাসান। তিনি একটি কলেজের শিক্ষার্থী। তাঁর বাবা ময়নাল ইসলাম ভূঁইয়া পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই)।

ময়নাল হোসেন সেদিন সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গে ছেলের লাশ শনাক্ত করেন, তখন এই প্রতিবেদক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ছেলের লাশ দেখার পর এই পুলিশ কর্মকর্তা নিজ বাহিনীর আরেকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ফোনে বলেছিলেন, ‘একজনকে মারতে কতগুলো গুলি লাগে, স্যার?’

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মৃত্যু: লাশ পেতে আর কত ভোগান্তি

 

পুরো যাত্রাবাড়ী অঞ্চলের পরিস্থিতি তখন ভয়াবহ ছিল। যাত্রাবাড়ী মৃত্যুপুরী হয়ে উঠেছিল। পুলিশ নির্বিচার গুলি করত।
তানভীর আহমেদ, যাত্রাবাড়ীর আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী

নির্বিচার গুলি ছোড়া হয়েছে উত্তরায়

গত বছরের ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত রাজধানীর উত্তরায় নিহত হন ৭০ জন। এর মধ্যে ১৯ জুলাই ১৬ জন এবং ৫ আগস্ট ৩২ জন নিহত হন। উত্তরায় বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীর পাশাপাশি নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন।

এর মধ্যে ১৮ জুলাই উত্তরার আজমপুরে কপালে গুলি লেগে মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ শহীদ হন। ওই দিন অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া আন্দোলনকারীদের মধ্যে পানি বিতরণ করছিলেন মুগ্ধ। পানির কেস হাতে নিয়ে ‘পানি লাগবে, পানি, পানি...’ বলছিলেন মুগ্ধ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই ভিডিও ব্যাপকভাবে ভাইরাল (ছড়িয়ে পড়ে) হয়।

ভাইরাল সেই ভিডিও ও মুগ্ধর মৃত্যুর ঘটনা ভীষণভাবে নাড়া দেয় স্কুলশিক্ষার্থী জুবায়ের আহম্মেদকে। একপর্যায়ে আন্দোলনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ২ আগস্ট উত্তরার আন্দোলনে যেদিন তিনি প্রথম অংশ নেন, সেদিনই তাঁর শরীরে ছররা গুলি লাগে। এরপরও আন্দোলন চালিয়ে যান তিনি। ৪ আগস্ট একটি গুলি তাঁর পাঁজরের নিচের অংশ ভেদ করে পাকস্থলী স্পর্শ করে। এখনো সেই গুলি বের করা যায়নি।

জুবায়ের আহম্মেদ গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বহু মানুষকে চোখের সামনে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেছি। আমি গুলিবিদ্ধ হওয়ার কিছুক্ষণ পর জ্ঞান হারাই। একটি হাসপাতালে নেওয়ার পর জ্ঞান ফেরে। দেখি মানুষ আর মানুষ—ব্যথায়, যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।’

গত বছরের ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত রাজধানীর উত্তরায় নিহত হন ৭০ জন। এর মধ্যে ১৯ জুলাই ১৬ জন এবং ৫ আগস্ট ৩২ জন নিহত হন।

ওই সময় উত্তরার পরিস্থিতি কেমন ছিল, সেই বর্ণনা দিয়েছেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিমি আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের দেখলেই গুলি করা হচ্ছিল। ২০ জুলাই একটি গলি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন তিনিসহ চার শিক্ষার্থী। তখন কয়েকজন পুলিশ সদস্য তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি করতে করতে বলছিল, ‘আন্দোলনে গেছিস, মর।’

পুলিশের সঙ্গে অস্ত্র হাতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মীরা

মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও রামপুরায় ছাত্র–জনতার আন্দোলন দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের (এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ) অনেক নেতা–কর্মী অস্ত্র হাতে মাঠে ছিলেন। তাঁদের গুলিতে অসংখ্য মানুষ হতাহত হন।

বিশেষ করে মিরপুর এলাকার পরিস্থিতি এমন ছিল যে বাসাবাড়িও নিরাপদ ছিল না। গত বছরের ১৯ জুলাই বাসায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় সাফকাত সামির নামে ১১ বছরের এক শিশু। তার মৃত্যুর পর ময়নাতদন্ত করতে বাধা দেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য মো. ইসমাইল হোসেন। পরে পরিবার বাধ্য হয়ে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফন করে।

মিরপুরে অস্ত্র নিয়ে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন যুবলীগের (এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ) সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন নিখিল ও তাঁর সহযোগীরা। সরকার পতনের পর তিনি আত্মগোপনে যান। তবে গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁর অন্যতম সহযোগী রিপন আহম্মেদ ওরফে রিংকু গ্রেপ্তার হন। পুলিশ জানিয়েছে, ছাত্র–জনতার আন্দোলন দমনে রিপন ও তাঁর সহযোগীরা অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিতেন ও গুলি করতেন। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের গুলিতে মিরপুরে ৬২ জন নিহত হন।

বহু মানুষকে চোখের সামনে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেছি। আমি গুলিবিদ্ধ হওয়ার কিছুক্ষণ পর জ্ঞান হারাই। একটি হাসপাতালে নেওয়ার পর জ্ঞান ফেরে। দেখি মানুষ আর মানুষ—ব্যথায়, যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।
জুবায়ের আহম্মেদ, উত্তরার আন্দোলনে অংশ নেওয়া স্কুলশিক্ষার্থী

মোহাম্মদপুর এলাকায় ঢাকা উত্তর সিটির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৎকালীন কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ (সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাতিজা), একই ওয়ার্ডের আরেকজন সাবেক কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান ওরফে রাজীব এবং আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের ব্যক্তিগত সহকারী মাসুদুর রহমান ওরফে বিপ্লব আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ছাত্র–জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে দেখা গেছে।

মোহাম্মদপুরে ছাত্র–জনতার ওপর গুলি ছুড়ছেন এমন দুটি ভিডিও প্রথম আলোর হাতে এসেছে। সেগুলো যাচাই করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের ঠিক এক দিন আগে ৪ আগস্ট ভিডিও দুটি ধারণ করা হয়। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, অস্ত্র হাতে আসিফ আন্দোলনকারীদের গুলি করছেন। আরেকটি ভিডিওতে তারেকুজ্জামান ও মাসুদুরকে গুলি করতে দেখা যায়। মোহাম্মদপুর এলাকায় গুলিতে নিহত হন ৪৩ জন।

গণ–অভ্যুত্থানের সময় ছাত্র–জনতা ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল রামপুরা এলাকায়। সেখানেও আন্দোলনকারীদের দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের (এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ) অনেক নেতা-কর্মী অস্ত্র হাতে মাঠে ছিল। গুলিতে রামপুরায় ৩২ জন নিহত হন।

এর বাইরে রাজধানীর বাড্ডা, ভাটারা, নিউমার্কেট, চানখাঁরপুল, চকবাজার, গুলিস্তান, আগারগাঁও, মহাখালী, হাতিরঝিল, কলাবাগান, তেজগাঁও, ফার্মগেট, লক্ষ্মীবাজার, গোলাপবাগ, ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, আদাবর, বাংলামোটর, শাহবাগ, পল্টন, বংশাল ও, মুগদায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে তখন পুলিশ গুলি ছুড়েছিল। এর মধ্যে বাড্ডা ও ভাটারায় ৫০ জন, বংশালে ১১ জন এবং নিউমার্কেট এলাকায় ১১ জন নিহত।

এর বাইরে গণ-অভ্যুত্থানের সময় নিহত অনেককে ‘বেওয়ারিশ’ হিসেবে দাফন করা হয়। রাজধানীর রায়েরবাজার কবরস্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয় ১১৪টি মরদেহ। এসব মরদেহের পরিচয় এখনো শনাক্ত হয়নি।

মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও রামপুরায় ছাত্র–জনতার আন্দোলন দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের (এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ) অনেক নেতা–কর্মী অস্ত্র হাতে মাঠে ছিলেন। তাঁদের গুলিতে অসংখ্য মানুষ হতাহত হন।

আবু সাঈদের মৃত্যু: প্রতিবাদে ফেটে পড়ে দেশ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় গত বছরের ১ জুলাই। এই আন্দোলনে দমাতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ১৬ জুলাই থেকে ব্যাপক মাত্রায় বলপ্রয়োগ শুরু করে। ১৬ জুলাই এক দিনেই ছয়জনের মৃত্যু হয়। সেদিন পুলিশের গুলিতে নিহত হন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। তাঁকে হত্যা করার দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে দেশ।

১৮ থেকে ২১ জুলাই—টানা চার দিন আন্দোলন দমাতে নির্বিচার গুলি করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে বিপুলসংখ্যক মানুষকে হত্যার পরও আন্দোলন দমাতে না পেরে ১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে দেশজুড়ে কারফিউ জারি করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এই ঘোষণা দেওয়ার সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘শুট অ্যাট সাইট’ বা দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

গণ-অভ্যুত্থানের সময় নিহত অনেককে ‘বেওয়ারিশ’ হিসেবে দাফন করা হয়। রাজধানীর রায়েরবাজার কবরস্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয় ১১৪টি মরদেহ। এসব মরদেহের পরিচয় এখনো শনাক্ত হয়নি।

গণ–অভ্যুত্থানের সময় গুলিতে নিহত ব্যক্তিদের তালিকায় চার বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৭০ বছর বয়সী মানুষও রয়েছেন। প্রথম আলোর অনুসন্ধান অনুযায়ী, ১৮ বছরের নিচে এমন ১৩১ শিশুর মৃত্যু হয়েছে তখন। যাদের বেশির ভাগের মৃত্যু হয়েছে গুলিতে। সরকারি গেজেটে শহীদদের তালিকায় শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শ্রমজীবী ও পেশাজীবীরা রয়েছেন।

ছাত্র–জনতার আন্দোলন দমন করতে তৎকালীন সরকার নৃশংস পদ্ধতি বেছে নিয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এমন নৃশংসতা চালানো হয়েছিল যে শিশুরাও বাদ যায়নি। যা ঘটেছিল, সেটি বর্বরতা। দেশে তখন চরম মানবিক বিপর্যয় ঘটেছিল। মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন হয়েছিল।

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর প্রতিবেদক মো. মামুনমো. জান্নাতুল নাঈম ও আবৃতি আহমেদসহ সংশ্লিষ্ট জেলার প্রতিনিধিরা)