
১৬ জুলাই ২০২৪। সময় দুপুর দেড়টা। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) এক নম্বর ফটকের সামনে জমায়েত হন ‘কোটা সংস্কার’ আন্দোলনকারীরা। এ সময় তারা বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। শুরু করে লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল ছোড়া। পুলিশের সঙ্গে যোগ দেয় ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের অস্ত্রধারী নেতাকর্মীরা। ভয়ে সবাই দৌড়ে পালাতে থাকে দিগিবদিক। শিক্ষার্থীদের দমনে পুলিশ প্রায় ২০০ রাউন্ড গুলি ও রাবার বুলেট ছোড়ে। কিন্তু একজন দাঁড়িয়ে থাকে বুক টান করে, দুই হাত প্রসারিত করে, তার নাম আবু সাঈদ। মুহূর্তেই তার বুক ঝাঁজরা হয়ে যায় পুলিশের গুলিতে। আবু সাঈদের এই ঘটনা পুরো আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। নতুন করে স্লোগান তৈরি হয়, ‘বুক পেতেছি গুলি কর, বুকের মধ্যে অনেক ঝড়’। আবু সাঈদই শিক্ষার্থীদের গুলির সামনে বুক পেতে দিতে শিখিয়েছে। আজ সেই হত্যাকাণ্ডের এক বছর। সরকার আবু সাঈদ স্মরণে দিনটিকে ‘জুলাই শহিদ দিবস’ ঘোষণা করেছে। দিনটিকে ঘিরে সরকারি-বেসরকারি নানা কর্মসূচি রয়েছে।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে গুলির সামনে সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠা আবু সাঈদের মৃত্যুর আগমুহূর্তের বিরল সেই ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। দৃশ্যটা হয়ে ওঠে প্রতিবাদের প্রতীক। আবু সাঈদের মৃত্যুতে অগ্নিগর্ভে রূপ নেয় কোটা আন্দোলন। কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন শেষ পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। মৃত্যুঞ্জয়ী ছাত্র-জনতার গণপ্রতিরোধের মুখে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী পৃষ্ঠা ১৫ কলাম ৪
যে হত্যা আন্দোলনের
প্রথম পৃষ্ঠার পর
ও তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর আবু সাঈদকে স্মরণের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশ সংস্কারে শুরু হয় নানা কার্যক্রম। কিন্তু এখনো বিচার অধরা। গ্রেফতার হয়নি আবু সাঈদ হত্যা মামলার মূলহোতারা। পরিবার, বন্ধুবান্ধব, সহপাঠী ও শিক্ষকসহ সবার একটাই প্রশ্ন—‘বিচার হতে কতদিন লাগবে?’
আবু সাঈদের ভাই আবু হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম শহিদ আবু সাঈদ। সে তো আইকনিক শহিদ। তার আত্মত্যাগ জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে রাজপথে লড়াই করতে মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, আসলে সবাই প্রত্যাশা করেছিল দিনদুপুরে আবু সাঈদকে গুলি করে শহিদ করে দেওয়া হয়েছে, এর বিচার দ্রুতম সময়ে হবে। আসলে ততটা দ্রুত হয়নি। বিচার-প্রক্রিয়া ধীরগতিতে চলছে। তদন্ত করতেই এক বছর পার করে দেওয়া হয়েছে। এখনো আমরা আশাবাদী ড. ইউনূসের শাসনামলেই বিচার-প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। আমরা প্রত্যাশা করছি, কিন্তু ওনারা কী করবেন, সেটা ওনাদের কাছে।’
আপনার ভাই যেমন একটি বাংলাদেশের জন্য জীবন দিয়েছেন, এক বছর পর এসে আপনি কি সেই বাংলাদেশ দেখেন? জবাবে আবু হোসেন বলেন, ‘আমার ভাই তো জীবন দিয়েছেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে। প্রথম যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেটা কোটার বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে। যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমার ভাই বা অন্যরা জীবন দিয়েছেন সেই বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশের পরিপূর্ণ রূপ আমরা পাইনি। আমরা এখনো দেখছি, সেই চাঁদাবাজি, দিনদুপুরে মানুষ হত্যা হচ্ছে। আমরা চাই সামনে যে নির্বাচিত সরকার আসবে, তারা যেন স্বৈরশাসন থেকে শিক্ষা নেয়। তারা যেন জনবান্ধব সরকার হয়, সেটা আমরা প্রত্যাশা করি। এক বছর পরও কাঙ্ক্ষিত বৈষম্যমুক্ত দেশ আমরা পাইনি।’
আবু সাঈদ ছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিল। ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স চূড়ান্ত পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পেয়ে উত্তীর্ণ হন। আবু সাঈদ সিজিপিএ ৩.৩০ পেয়ে সম্মিলিত মেধাতালিকায় ১৪তম স্থান অধিকার করেন।
মামলা ও বিচারের অবস্থা : পুলিশের গুলিতে শিক্ষার্থী আবু সাঈদ নিহতের ঘটনায় তার বড় ভাই রমজান আলী বাদী হয়ে একটা মামলা করেন। ঐ মামলায় ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরো ৩০-৩৫ জনকে আসামি করা হয়। পরে আসামির তালিকায় নতুন আরো সাত জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সাবেক উপাচার্য, সাবেক প্রক্টর, সাবেক ১১ জন পুুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যসহ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাদের আসামি করা হয়। এখন পর্যন্ত এ মামলায় দুই পুলিশ সদস্য, এক শিক্ষক ও একজন ছাত্রলীগ নেতা গ্রেফতার হয়েছে।
শহিদ আবু সাঈদ হত্যা মামলায় গত ৩০ জুন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ প্রসিকিউশন থেকে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়। এ মামলায় ৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে চার জন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন পুলিশের সাবেক এএসআই আমির হোসেন, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রোক্টর শরিফুল ইসলাম ও ছাত্রলীগ নেতা ইমরান আকাশ। এছাড়া রাফিউল হাসান রাসেল ও আনোয়ার পারভেজ নামের দুই জন আসামি বর্তমানে অন্য মামলায় কারাবন্দি, যাদের গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়। বাকি ২৪ জন পলাতক আসামিকে ২২ জুলাইয়ের মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
ঘটনার পরের মাসগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট বৈঠকে দুই জন শিক্ষক ও সাত জন কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বেরোবির শিক্ষার্থীরা ১৬ জুলাইকে শহিদ আবু সাঈদ দিবস হিসেবে পালন করছেন। পুরো ক্যাম্পাসে কালো ব্যানার, স্মরণসভা, কবিতা পাঠ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ নানা আয়োজনে তাকে স্মরণ করা হচ্ছে। ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুল বলেন, ‘সাঈদ ভাই আমাদের আন্দোলনের অনুপ্রেরণা ছিলেন। এখন তিনি ইতিহাস হয়ে আছেন। আমরা তার সাহস মনে রেখে অন্যায়ের বিরুদ্ধে থাকব।’
দিবসটি ঘিরে নানা কর্মসূচি : বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, দিবসটির কর্মসূচিতে অংশ নিতে ক্যাম্পাসে আসছেন অন্তর্বর্তী সরকারের চার উপদেষ্টা। তারা হলেন—আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা প্রফেসর ড. আসিফ নজরুল, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা প্রফেসর ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার, পানিসম্পদ ও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং মুক্তিযুদ্ধ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম, বীরপ্রতীক।
এদিন সকাল সাড়ে ৬টায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শহিদ আবু সাঈদের পৈতৃক গ্রাম রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামের উদ্দেশে যাত্রা শুরু হবে। সকাল সাড়ে ৭টায় কবর জিয়ারত শেষে সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে কালো ব্যাজ ধারণ ও শোক র্যালি অনুষ্ঠিত হবে। সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শহিদ আবু সাঈদ তোরণ ও মিউজিয়ামের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং ১০টা ১৫ মিনিটে শহিদ আবু সাঈদ স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে। সকাল সাড়ে ১০টায় অনুষ্ঠিত হবে আলোচনাসভা। বিকাল সাড়ে ৩টায় চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা এবং বাদ আসর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
প্রধান উপদেষ্টার বাণী : প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘জুলাই শহিদ দিবস’ উপলক্ষ্যে দেওয়া এক বাণীতে বলেছেন, জুলাই শহিদরা স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি বৈষম্যহীন, দুর্নীতি ও স্বৈরাচারমুক্ত নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থার। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া এই সুযোগকে কাজে লাগাতে সবার ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। জুলাইয়ের চেতনাকে ধারণ করে নতুন বাংলাদেশের পথে দৃপ্ত পদভারে একযোগে সবাই এগিয়ে যাব—আজকের দিনে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার। তিনি বলেন, প্রথম বারের মতো দেশ জুড়ে পালিত হচ্ছে ‘জুলাই শহিদ দিবস’। এই দিনে আমি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারের শৃঙ্খল থেকে জাতিকে মুক্ত করার আন্দোলনে আত্মোত্সর্গকারী শহিদদের।