Image description

চাঁদপুর শহরের একটি ভাড়া বাড়িতে ২০১৯ সালে যাত্রা শুরু করা চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চাঁবিপ্রবি) শুরু থেকেই নানা বিতর্কে জর্জরিত। জমি অধিগ্রহণ নিয়ে দুর্নীতি, প্রশাসনিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার এবং সর্বশেষ ‘অব্যাহতিপ্রাপ্ত’ দুই শিক্ষকের কর্মকাণ্ডে ‘অতিষ্ঠ’ হয়ে উঠেছে প্রশাসন। চাপের মুখে তাদের সাময়িকভাবে চাকরিতে যোগদানের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতার অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ এবং তার বৈধতা নিয়েও চলছে একের পর এক আলোচনা-সমালোচনা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি (আইসিটি) বিভাগের প্রাক্তন প্রভাষক নাজিম উদ্দিন ও কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের প্রাক্তন প্রভাষক প্রিন্স মাহমুদকে শিক্ষানবিশকাল শেষ হওয়ার আগেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ৫ আগস্টের পর নিজেদের বঞ্চিত দাবি করে নিয়োগ ফিরে পেতে বিশ্ববিদ্যালয়ে নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করছেন এ দুই শিক্ষক। অভিযোগ রয়েছে, চাকরি ফেরত পাওয়ার জন্য তারা শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছেন এবং উপাচার্যকেও চাপ দিচ্ছেন।

শিক্ষানবিশকাল শেষ হওয়ার আগেই অব্যাহতি প্রাপ্ত দুই শিক্ষককে বেতন-ভাতা প্রদান করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৫ লাখ ৭২ হাজার ৪৪৬ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে মর্মে অডিট আপত্তি জানানো হয়। ২০২০ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৪৩(৪) ও ৪৩(৫) ধারা এবং নিয়োগপত্রের শর্ত অনুযায়ী, দুই বছরের শিক্ষানবিশকালে সন্তোষজনক কাজ না করলে কর্তৃপক্ষ কোনো কারণ ছাড়াই অব্যাহতি দিতে পারে। সেই নিয়ম মেনেই নাজিম উদ্দিন ও প্রিন্স মাহমুদকে অব্যাহতি দেওয়া হলেও পরে তাদের বেতন দেওয়া হয়েছে, যা নিয়ম লঙ্ঘন।

সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, নাজিম উদ্দিন ও প্রিন্স মাহমুদ তাদের অনুসারী কিছু শিক্ষার্থীর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভা ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন। এমনকি তাদের চাকরিতে পুনর্বহাল ও বেতন কার্যকর করার লক্ষ্যে আন্দোলনের হুমকি দিয়ে একটি অফিস আদেশ জারির ব্যবস্থা করেছেন। আগামী ১৯ জুলাই অনুষ্ঠেয় সিন্ডিকেট সভায় এ আদেশের বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে। যদিও চাকরি থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর তাদের বেতন-ভাতা দেওয়া নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর।

শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, শিক্ষানবিশকাল শেষ হওয়ার আগেই অব্যাহতি প্রাপ্ত দুই শিক্ষককে বেতন-ভাতা প্রদান করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৫ লাখ ৭২ হাজার ৪৪৬ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে মর্মে অডিট আপত্তি জানানো হয়। ২০২০ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৪৩(৪) ও ৪৩(৫) ধারা এবং নিয়োগপত্রের শর্ত অনুযায়ী, দুই বছরের শিক্ষানবিশকালে সন্তোষজনক কাজ না করলে কর্তৃপক্ষ কোনো কারণ ছাড়াই অব্যাহতি দিতে পারে। সেই নিয়ম মেনেই নাজিম উদ্দিন ও প্রিন্স মাহমুদকে অব্যাহতি দেওয়া হলেও পরে তাদের বেতন দেওয়া হয়েছে, যা নিয়ম লঙ্ঘন।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে চাঁবিপ্রবির এক শিক্ষক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘নাজিম উদ্দিন ও প্রিন্স মাহমুদ শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার বাইরে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছেন। কেউ তাদের মতের বিরুদ্ধে গেলেই শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে আন্দোলনে নামানো হচ্ছে। এমনকি সাংবাদিকদেরও হেনস্তার ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি স্থানীয় একজন গণমাধ্যমকর্মী তথ্য সংগ্রহে গেলে তারা শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে হেনস্থা করেন।;’

চাঁবিপ্রবির এক কর্মকর্তা জানান, প্রিন্স ও নাজিম বর্তমানে ‘অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত’ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মাহাবুবুর রহমানের সঙ্গে একত্র হয়ে প্রশাসনের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ, আন্দোলন ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর কাজে লিপ্ত রয়েছেন। তারা সরকারি দলের সমর্থনে নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও, বর্তমানে নিজেদের বিপ্লবী পরিচয় দিয়ে প্রশাসনের প্রতিটি পদক্ষেপকে বাধাগ্রস্ত করছেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রিন্স মাহমুদ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমাদের চাকরি থেকে অব্যাহতির সিদ্ধান্ত অবৈধ ছিল। কেননা সরকারি চাকরির একটি সুনির্দিষ্ট বিধি রয়েছে। সেই বিধি অনুযায়ী চাকরি থেকে অব্যাহতি দিতে হলে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। তবে কোনো তদন্ত ছাড়াই চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। পরে ইউজিসির সুপারিশ এবং মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদের চাকরি ফেরত দেওয়া হয়েছে। 

যদিও চাকরিবিধি অনুযায়ী, শিক্ষানবিশকালীন কাউকে কোনো কারণ দর্শানোর নোটিশ ছাড়াই চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার বিধান রয়েছে। এ ছাড়া ইউজিসি কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তাদের চাকরি ফেরত দেওয়ার কোনো নির্দেশনাও দেওয়া হয়নি।

মন্ত্রণালয় বলেছে, নাজিম উদ্দিন ও প্রিন্স মাহমুদের বিষয়ে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে। শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের অডিট মেমোতে এ দুইজনকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। চাকরি থেকে অব্যাহতির পরও তাদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করার বিষয়টি অবৈধ বলে জানিয়েছেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বক্তব্য জানতে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদককে অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনা অমান্য করে বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের চাঁদপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান বাবুকে সিনিয়র ক্যাটালগার পদে অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ইউজিসির বাজেট পরিপত্র অনুযায়ী, কমিশনের পূর্বানুমোদন ছাড়া এ ধরনের নিয়োগ অবৈধ।

ছাত্রলীগ কিংবা বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না দাবি করে মাহবুবুর রহমান বাবু দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সত্যতা নেই। একটি কুচক্রী মহল আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে।’ আপনি ছাত্রলীগ এবং বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এ সংক্রান্ত প্রমাণ রয়েছে বলা হলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. পেয়ার আহম্মেদ এসব ঘটনায় চাপে রয়েছেন। তিনি প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলেও, নিয়মের বাইরে গিয়ে যেভাবে রাজনৈতিক ও অন্যভাবে চাপ তৈরি করা হচ্ছে, তা ন্যূনতম অ্যাকাডেমিক পরিবেশ বজায় রাখার পথকে কঠিন করে তুলেছে।

চাপ প্রয়োগের বিষয়টি স্বীকার করে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক পেয়ার আহমেদ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘নানা সময় শিক্ষার্থীদের দিয়ে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। সম্প্রতি তিনজন সিন্ডিকেট সদস্যকে নিয়োগ না দিতে চাপ দেওয়া হয়। তবে আমরা চাপ সামলে কাজ করার চেষ্টা করছি। অব্যাহতিপ্রাপ্ত নাজিম উদ্দিন ও প্রিন্স মাহমুদকে শর্তসাপেক্ষে সাময়িকভাবে চাকরিতে যোগদানের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাদের বিষয়ে সিন্ডিকেটে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এবং বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদককে অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, ‘অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ না দিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশনার কথা আমরা জানি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের স্বার্থে নানা সময় এডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া যায়।’

মাহাবুবুর রহমান বাবু সম্পর্কে একেক সময় একেক রকম তথ্য পাওয়া গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘একটি পক্ষ বলছে তিনি ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন। আরেকপক্ষের মতে, তিনি এ দলের রাজনীতি করেননি। আমরা গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাইনি। তার বিষয়ে যে তথ্যগুলো পাওয়া গেছে; সেগুলো সিন্ডিকেট সভায় উত্থাপন হবে। এরপর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

নাজিম উদ্দিন ও প্রিন্স মাহমুদের বিষয়ে তদন্ত করেছিল ইউজিসি। তদন্ত কমিটিতে ইউজিসি সদস্য (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান এবং সংস্থাটির উপ-সচিব (লিগ্যাল, জেলা ও দায়রা জজ) নূরনাহার বেগম শিউলী। জানতে চাইলে নূরনাহার বেগম শিউলী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘প্রায় সাত মাস আগে তদন্ত হয়েছে। প্রতিবেদনে আমরা কোনো সিদ্ধান্তের কথা জানাইনি। এছাড়া প্রতিবেদনে সে সময় কী লেখা হয়েছে সেটিও আমার মনে নেই।’