Image description

বৈষম্যবিরাধী ছাত্রআন্দোলন চলাকালে বুক চিতিয়ে পুলিশের গুলিকে আলিঙ্গন করে শহীদ হন আবু সাঈদ। আরও একবার স্বৈরাচারমুক্ত হয় বাংলাদেশ। আবু সাঈদের মৃত্যু শুধু দেশেই পরিবর্তন আনেনি, বদলে গেছে তার পরিবারও।

অনেকেই বলছেন—আবু সাঈদের যে আদর্শ, তা টিকিয়ে রাখার দায় তার পরিবারের। অনেকের মতে, সময় এসেছে তাদের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার। রংপুরের পীরগঞ্জের বাবনপুর গ্রামের সেই সাধারণ কৃষক, শহীদ আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেনের দরজায় এখন কড়া নাড়ছে রাজনীতি।

গত ২ জুলাই নিজ বাড়ির মাটির ঘরের বারান্দায় বসে সেসব কথা জাগো নিউজকে বলেন মকবুল হোসেন।

টিভিতে শুনেছি ড. ইউনূসের সরকার ৩০ লাখ করে টাকা দেবে। মাসে মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের মতো ভাতা দেওয়া হবে। কিন্তু সেসবের কিছু এখন পর্যন্ত পাইনি

তিনি বলেন, দেশের বড় কয়েকটি রাজনৈতিক দল তাকে ও তার বাকি ছেলেদের কাউকে কাউকে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। তবে কোনো একটি দলের হতে চান না তারা। শহীদ সন্তানকে তিনি নিরপেক্ষ রাখতে চান।

 

আমরা কোনো একটি রাজনৈতিক দলের হতে চাই না

মকবুল হোসেন বলেন, ‘সবাই টানে দলে যোগ দেওয়ার জন্য। আমরা যাই না। আমরা নিরপেক্ষ থাকতে চাই। কোনো একটি দলের হতে চাই না। শহীদ আবু সাঈদকে সবার করে রাখতে চাই।’

তবে মকবুল হোসেনের বয়স হয়েছে। সংসারের বড় সিদ্ধান্ত নেন অন্য ছেলেরা- শহীদ আবু সাঈদের ভাইয়েরা। সে কারণেই সব বিষয়ে শেষ কথা জানেন না মকবুল হোসেন।

 

ওরা এমনভাবে কাঁদছিল যেন তাদেরই ছেলে মারা গেছে। দিশেহারা হয়ে পড়ি। পরে খবর আসে—আবু সাঈদ গুলিবিদ্ধ, কিছুক্ষণের মধ্যেই শুনি—মারা গেছে আমার ছেলেটা

একটু ভেবে আবার বলেন, ‘নিরপেক্ষ তো থাকতেই চাই। তবে কী হবে জানি না। ছেলেরা নিয়মিত ঢাকায় যায়। তারা কী করবে জানি না।’

কোন কোন দল থেকে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার অফার পেয়েছেন জানতে চাইলে মকবুল হোসেন বলেন, ‘জামায়াত থেকে অফার পেয়েছি, বিএনপিও বলেছে তাদের সঙ্গে যোগ দিতে।’

তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলন সংশ্লিষ্টদের নিয়ে গঠিত রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ এখনো সরাসরি কিছু বলেনি বলে জানান আবু সাঈদের বাবা। তবে হাসনাত আব্দুল্লাহসহ এনসিপি নেতাদের সঙ্গে ছেলেদের যোগাযোগ আছে বলে জানান তিনি।

আমরা কোনো একটি রাজনৈতিক দলের হতে চাই না

গত ১ জুলাই এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ বেশ কয়েকজন নেতা শহীদ আবু সাঈদের বাড়িতে গিয়ে তার কবর জিয়ারত করেন। তারা মকবুল হোসেনকে জানান, ১৬ জুলাই ‘শহীদ আবু সাঈদ দিবস’র পরিবর্তে ‘জুলাই শহীদ দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

আমার ছেলে মেধাবী ছিল। কিন্তু শুধু মেধা থাকলে হয় না—গরিবদের জন্য চাকরি পাওয়া এখনো অনেক কষ্টের। পাশের বাড়ির ছেলেটাও মেধাবী, মাস্টার্স করেছে, তবু বসে আছে। আবু সাঈদ ভয় পেতো, ওর-ও সে দশা হবে কি না। তাই হয়তো কোটাবিরোধী আন্দোলনে গিয়েছিল

এ বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে মকবুল হোসেন বলেন, ‘আবু সাঈদের নামেই দিবসটা থাকা উচিত।’

সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার হিসেবে যে ৩০ লাখ টাকা ও মাসিক ভাতা পাওয়ার কথা তা এখনো পাননি বলেও অনুযোগ করেন মকবুল হোসেন।

তিনি বলেন, ‘টিভিতে শুনেছি ড. ইউনূসের সরকার ৩০ লাখ করে টাকা দেবে। মাসে মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের মতো ভাতা দেওয়া হবে। কিন্তু সেসবের কিছু এখন পর্যন্ত পাইনি।’

শোক, ক্ষোভ আর অনিশ্চয়তার মধ্যেই ছেলের মৃত্যুর স্মৃতি মকবুল হোসেনকে প্রতিদিন তাড়া করে ফেরে। তিনি বলেন, আবু সাঈদ আন্দোলনে নেমেছিল বলে জানতেন না।

‘মারা যাওয়ার পরেই জানতে পারি। সেদিন বিকেল ৩টার দিকে পাশের বাড়ির এক ছেলে ঢাকায় থাকা অবস্থায় তার মাকে ফোন করে খবর দেয়। আমি তখন মাঠ থেকে ফিরেছি, বিশ্রাম নিচ্ছি। হঠাৎ পাশের বাড়ির ছেলেটার মা এসে বললো, ‘আবু সাঈদের নাকি কিছু হয়েছে!’

আমরা কোনো একটি রাজনৈতিক দলের হতে চাই না

‘ওরা এমনভাবে কাঁদছিল যেন তাদেরই ছেলে মারা গেছে। দিশেহারা হয়ে পড়ি। পরে খবর আসে—আবু সাঈদ গুলিবিদ্ধ, কিছুক্ষণের মধ্যেই শুনি—মারা গেছে আমার ছেলেটা।’

এরপর আবু সাঈদের ভাইয়েরা রংপুর মেডিকেল কলেজে ছুটে গেলেও সেখানে মরদেহ মেলেনি। পুলিশ ছাত্রদের কাছ থেকে মরদেহ নিয়ে মর্গে রেখেছিল। পরে রাত ৩টার দিকে পুলিশের পাহারায় মরদেহ বাড়িতে আসে।

‘দেখি বুকটা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। শুধু রক্ত। উঠোনে গোসল করানো হলো। গোসলের পানি যেদিকে গড়ালো, রক্ত সেদিকে ছড়িয়ে গেলো।’ বলছিলেন মকবুল হোসেন।

সেই আঁধারে আবু সাঈদকে দাফনের জন্য চাপ দেওয়া হয়। মকবুল হোসেন বলেন, ‘পুলিশের বড় অফিসারেরা এসে আমাকে বোঝালো—রাতে দাফন দিতে হবে। আমি স্পষ্ট বললাম, সেটা সম্ভব না। তারা বললো, তাহলে ভোর ৬টায় দাফন করুন। তাতেও আমি রাজি হলাম না। শেষমেশ সকাল ৮টায় দাফনের সময় ঠিক হলো।’

সেদিন আবু সাঈদের জানাজায় ঈমাম শেখ হাসিনাকে স্বৈরাচার বলায় তাকে ধাওয়া করা হয়। তিনি পালিয়ে বাঁচেন। এর কয়েকদিন পর মকবুল হোসেনের পরিবারকে ঢাকায় নেওয়া হয়। গণভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা হয়।

সেদিনের ঘটনা মনে করে মকবুল হোসেন বলেন, ‘আমার ছেলেরা তাদের ভাই হত্যার বিচার চায়। হাসিনা বললো, তদন্ত করে বিচার হবে। পরে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ধরিয়ে দেয়। আমি টাকা নিতেই চাইনি।’

সরকারি সেই টাকার লভ্যাংশ প্রতি মাসে মকবুল হোসেনের সংসারে যুক্ত হয়।

এরপর সরকার পরিবর্তন হয়। শহীদ সাঈদের পরিবারকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তিন লাখ টাকা দেন। জামায়াতে ইসলামী সাড়ে তিন লাখ, জাতীয় পার্টি ৬৫ হাজার, আর স্থানীয় এক বিএনপি নেতা ৬০ হাজার টাকা দেন পরিবারকে। সাধারণ মানুষও এগিয়ে আসে, কেউ দুই হাজার, কেউ পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে সাহায্য করে।

মকবুল হোসেন ছিলেন একজন সামান্য কৃষক। দুই ঘরের আর কোনো সন্তানকে উচ্চশিক্ষা দিতে না পারলেও, ছোট ছেলে আবু সাঈদ পা রেখেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠে। এ যাত্রায় বাবার সাধ্যের চেয়েও বড় ছিল আবু সাঈদের একাগ্রতা, অধ্যবসায় আর স্বপ্ন দেখার সাহস।

সেসব কথা স্মরণ করে মকবুল হোসেন বলেন, ‘স্বপ্ন ছিল—ছেলে চাকরি করবে, আমরা তা দেখে মরবো। সেই স্বপ্নও পূরণ হলো না।’

আবু সাঈদের মৃত্যুর এক বছর কেটে গেলেও বিচার এখনো অসম্পূর্ণ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর ও দুই পুলিশ সদস্য গ্রেফতার হলেও বাকি আসামিরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। গুলির নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। তার বিচার সবার আগে হওয়া উচিত। তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।’

আবেগ চেপে রাখা কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে মেধাবী ছিল। কিন্তু শুধু মেধা থাকলে হয় না—গরিবদের জন্য চাকরি পাওয়া এখনো অনেক কষ্টের। পাশের বাড়ির ছেলেটাও মেধাবী, মাস্টার্স করেছে, তবু বসে আছে। আবু সাঈদ ভয় পেতো, ওরও সে দশা হবে কি না। তাই হয়তো কোটাবিরোধী আন্দোলনে গিয়েছিল।’

ছেলেকে হারিয়ে বুক শূন্য হলেও শহীদের বাবা হিসেবে কিছুটা গর্ব মিশে আছে তার কণ্ঠে। ‘হাসিনার আমলে যারা জেলখানায় ছিল, তারা আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানায়। মনে হয়, আমার ছেলের রক্তের বদৌলতেই আল্লাহ তাদের সেই ফরিয়াদ কবুল করেছেন। তারা নিরাপদে ঘরে ফিরেছে, কথা বলার সাহস ফিরে পেয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ওর রক্তের বিনিময়ে দেশ মুক্ত হয়েছে, স্বৈরাচার কেঁপে উঠেছে। কিন্তু ঘুস ছাড়া এখনো চাকরি মেলে না, অনিয়ম থেমে নেই। দেশটা ঠিকভাবে চালাতে পারছে না কেউ।’

একটু থেমে আবার বলেন, ‘মানুষ আসে কবর জিয়ারতে, দেখে যায়, আমাদের সান্ত্বনা দেয়। আমি কাঁদি না—কিন্তু যখন দেখি দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসে, তখন বুকটা ভার হয়ে আসে।’