Image description
♦ সরেজমিন পঙ্গু হাসপাতাল ♦ মাথায় আঘাতের জন্য দায়ী খেলনা হেলমেট ♦ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় হাত এবং পা

সকাল ৯টা বাজতেই জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) টিকিট কাউন্টারে ভীষণ ভিড়। লাইনের দৈর্ঘ্য পৌঁছেছে পার্কিং পর্যন্ত। ছোট ভাই ফায়সুলকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে রেখে টিকিট আনতে কাউন্টারে গেছেন বড় ভাই মোহাইমিনুল। পাশে দাঁড়িয়ে মা রীতা বেগম। তিনি বলেন, ‘মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হাত এবং পায়ের হাড় ভেঙে গেছে ফায়সুলের। টাঙ্গাইল থেকে চিকিৎসকরা উন্নত চিকিৎসার জন্য পঙ্গু হাসপাতালে পাঠিয়েছেন।’ কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটল জানতে চাইলে রীতা বেগম বলেন, ‘এসএসসি পাস করার পর মোটরসাইকেল কেনার বায়না করে ফায়সুল। কলেজে ক্লাস করতে সাইকেলে যাবে না। মোটরসাইকেল দিতেই হবে এমন জেদ ধরে বসে। ছেলের জেদের কাছে হার মেনে কৃষক বাবা জমানো টাকা থেকে মোটরসাইকেল কিনে দেন। টাঙ্গাইলের একটি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে ফায়সুল। ১০ জুলাই বিকালে মোটরসাইকেল নিয়ে বের হলে ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত হয় সে।’

শুধু ফায়সুল নয়, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত রোগীদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টায় পঙ্গু হাসপাতালের বহির্বিভাগ এবং জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে ১২ জন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এসব রোগীর বেশির ভাগ হাত, পা, নাক, মাথা এবং মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়েছে। অনেককে হুইলচেয়ারে বসানোর মতো অবস্থা নেই, ট্রলিতে শুইয়ে ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে হচ্ছে।

জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) আবাসিক সার্জন (আরএস) ডা. সাইফুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত রোগী আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এই রোগীদের অধিকাংশ তরুণ। অনেক রোগীর ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার বয়সই হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত রোগীদের অধিকাংশের পা এবং হাত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পায়ের হাড় টিবিয়া, ফিবুলা এবং ফিমার ভেঙে যাওয়া রোগী বেশি আসে। অনেক রোগী এত বাজেভাবে আহত হয় যে, পা হারিয়ে পঙ্গু হয়ে যেতে হয়। ঈদের সময় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি পেয়েছি।’

শুধু পায়ে নয়, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পাওয়া রোগীদের সংখ্যাও কম নয়। গাজীপুরের শ্রীপুর থেকে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল মামুন হোসেনকে। তার ভগ্নীপতি শাকিল আহমেদ বলেন, ‘ঈদের পরের দিন বন্ধুর মোটরসাইকেলে বেড়াতে বের হয়েছিল মামুন। মহাসড়কে কাভার্ড ভ্যানের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে মাথায় এবং হাতে আঘাত পায় সে। মাথার আঘাত গুরুতর হওয়ায় ঢাকা নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল এতদিন। হাতের একটা অপারেশনের জন্য পঙ্গু হাসপাতালে আনা হয়েছে।’ মাথায় হেলমেট ছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চালকের মাথায় মজবুত হেলমেট ছিল, কিন্তু যাত্রীর হেলমেট দুর্ঘটনা ঠেকানোর মতো ছিল না। মামলা ঠেকানোর জন্য রেখেছিল। ওই হেলমেট ভেঙে মাথায় আরও বেশি আঘাত লেগেছে মামুনের।’

পঙ্গু হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, গত বছর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৯ হাজার ৭৯৯ জন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) মাসিক প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, এ বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত দেশে ২ হাজার ৪৮২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে শুধু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সংখ্যা ৯৩৭টি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সামছুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চার চাকার যানবাহনের তুলনায় দুই চাকার বাহনকে ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলেছে। এই মোটরসাইকেল চালকদের বড় অংশ তরুণ। তাদের মধ্যে গতির ঝড় তোলা এবং আইন মানার প্রবণতা কম।’ তিনি আরও বলেন, ‘পৃথিবীর অনেক দেশ মোটরসাইকেল উৎপাদন এবং ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অপেশাদারিত্বের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের মোটরসাইকেল কোম্পানিকে দেশে কোম্পানি খোলার অনুমোদন দিয়েছে, রেজিস্ট্রেশন ফি অর্ধেক করেছে, বেশি সিসির ক্ষমতাসম্পন্ন মোটরসাইকেল চালানোর অনুমতির মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে বেড়েছে পঙ্গুত্ব এবং প্রাণহানি।’