Image description

পতিত আওয়ামী সরকারের ইশারায় দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) রীতিমতো হাতিয়ারে পরিণত করেছিলেন সংস্থাটির সাবেক তিন চেয়ারম্যান। তারা হলেন-এম বদিউজ্জামান, সৈয়দ ইকবাল মাহমুদ ও মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লা।

 

সংস্থাটির ভাবমূর্তি ধ্বংস করে যাওয়া এ তিন ব্যক্তি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কানাডায় বিলাসী জীবনযাপন করছেন ইকবাল মাহমুদ। আর বদিউজ্জামান ও মঈনউদ্দীন আবদুল্লা দেশেই আছেন নীরবে-নিভৃতে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার আমলে বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা ধামাচাপার ‘কারিগর’ ছিলেন তিনজন। তাদের ইশারায় আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিদের রক্ষা করা হতো। শুধু তাই নয়, মামলার জালে ফাঁসানো হতো সরকারবিরোধী নেতা ও ব্যবসায়ীদের। আবার তাদের বিরুদ্ধে আছে ব্যাংক-বিমা লোপাটকারী অলিগার্কদের (যারা শুধু ক্ষমতা ও অর্থের মালিকই নন, প্রচুর সম্পদের উৎসগুলোর নিয়ন্ত্রকও) ছেড়ে দিয়ে অঢেল অর্থ উপার্জনের অভিযোগও।

জানা যায়, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের শেষের দিকে দুদকের চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগ পান এম বদিউজ্জামান। অনেকটাই সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার পর নানা বিতর্কের জন্ম দেন তিনি (বদিউজ্জামান)। 

২০১৩ সালের ২৬ জুন থেকে ২০১৬ সালের ১৩ মার্চ পর্যন্ত দুদক চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন বদিউজ্জামান। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক ছিলেন দুবার। বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মহাপরিচালকও ছিলেন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন প্রকাশ করেছিলেন বদিউজ্জামান। দুদক চেয়ারম্যান থাকাকালে তার বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অভিযোগ হচ্ছে-পদ্মা সেতু দুর্নীতির ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া।

 সেসময় পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলায় সেতু বিভাগের তৎকালীন সচিব মোশারফ হোসেন ভূঁইয়াসহ কয়েকজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। মোশারফ হোসেনকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল। পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান। বদিউজ্জামানের তত্ত্বাবধানে এ মামলা থেকে আসামিদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। চেয়ারম্যান হিসাবে বিদায়ের দিন তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে আমরা যে এজাহার দায়ের করেছিলাম, তাতে মামলা করার মতো কোনো মেরিট ছিল না। এটা ঠিক হয়নি। তবে পরবর্তী তদন্তে আমরা প্রমাণ করেছি অভিযোগটি মিথ্যা।’

এছাড়া সাবেক সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মোজাম্মেল হোসেন এবং বিটিএমসির সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালামের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। রেলের কালো বিড়াল কেলেঙ্কারিসহ নানা দুর্নীতির ঘটনায় বেশকিছু সরকারি কর্মকর্তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। 

বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির অভিযোগও ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। এসব কাণ্ডে চরম বিতর্কিত হয় বদিউজ্জামান কমিশন। অভিযোগ আছে-অনেক অনুসন্ধান ও মামলার ঘটনা নিষ্পত্তি করা হয় মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে। বদিউজ্জামান কমিশনের কমিশনার ছিলেন মো. সাহাবুদ্দিন (বর্তমানে রাষ্ট্রপতি) ও ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ।

দুদক সূত্র জানায়, সংস্থাটিকে সবচেয়ে কলঙ্কিত করেছেন সৈয়দ ইকবাল মাহমুদের কমিশন। ২০১৬ সালের ১০ মার্চ যোগ দিয়ে ২০২১ সালের ১৪ মার্চ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এই কমিশনের সময় তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়ন ছাড়া স্বাধীন সংস্থা হিসাবে দুর্নীতি প্রতিরোধে কোনো কাজ হয়নি।

আমলা নিয়ন্ত্রিত যাবাক (অভিযোগ যাচাই-বাছাই কমিটি) গঠন করেছিল এই কমিশন। ফলে বড় বড় অনেক দুর্নীতির অভিযোগ এ কমিটি পর্যায়েই গায়েব করে ফেলা হয়েছে। আবার দুদকের তফশিলভুক্ত নয়-এমন অভিযোগে বিরোধী দলের নেতা ও ব্যবসায়ীদের জালে ফাঁসানো হয়েছে। 

অভিযোগ আছে-বিদায়ের আগে রাতারাতি তিনি অন্তত ৫০০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মামলা ও অনুসন্ধান নিষ্পত্তি করে যান। গণহারে অভিযুক্তদের দায়মুক্তি দিয়ে তিনি কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে কানাডায় পাচার করে বাড়ি-গাড়িসহ বিপুল সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। 

বর্তমানে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে সেখানে বিলাসী জীবনযাপন করছেন। ইকবাল কমিশনের দুই কমিশনার ছিলেন আ ফ ম আমিনুল ইসলাম ও মোজাম্মেল হক খান। এর মধ্যে মোজাম্মেল হক খানের বিরুদ্ধেও নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ আছে। ইতোমধ্যে তার দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, দুদকের ভেতরে-বাইরে ‘মেরুদণ্ডহীন’ কমিশন হিসাবে পরিচিত মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লা কমিশন। এই কমিশনেও কমিশনার হিসাবে কাজ করেন মোজাম্মেল হক খান। তার সঙ্গে ছিলেন জহুরুল হক। পরে মোজাম্মেল হক খানের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন আছিয়া খাতুন। 

এই কমিশন আওয়ামী লীগের অনেক সাবেক সংসদ-সদস্য ও বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছিল। অনুসন্ধানের নামে রাজনৈতিক ‘পুতুলনাচ’ ছাড়া কিছুই হয়নি। অনুসন্ধান ফাইল চালুর পর দীর্ঘ সময় ফেলে রেখে একপর্যায়ে বিপুল অর্থের বিনিময়ে অনেকের ফাইল পরিসমাপ্তি করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাবেক সংসদ-সদস্য নজরুল ইসলাম বাবুর বিরুদ্ধে তিন দফা অনুসন্ধান শুরু হলেও প্রতিবারই তাকে ‘ক্লিনচিট’ দেওয়া হয়। 

এছাড়া আওয়ামী লীগের দোসর বহুল আলোচিত ডায়মন্ড ব্যবসায়ী দীলিপ কুমার আগরওয়ালার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে তিন দফা অনুসন্ধান করা হলেও প্রতিবারই তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি কারাবন্দি। ছাগলকাণ্ডে ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’তে পরিণত হওয়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য মতিউর রহমান তিন চেয়ারম্যানের আমলে চার দফা অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পান। 

অথচ ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ‘গণেশ’ উলটে যায়। ‘মেরুদণ্ডহীন’ এই কমিশন গণহারে পতিত সরকারের সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালু এবং মামলা করে চেয়ার টেকানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। যাদের বিরুদ্ধে লোকদেখানো অনুসন্ধান ও মামলা করে আবদুল্লা কমিশন বাহবা নেওয়ার চেষ্টা করেছিল, তাদের অনেককেই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বারবার ‘ক্লিনচিট’ দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লা মোবাইল ফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি স্বাধীনভাবে কাজ করেছি। তবে ওই সময়ের কাজ নিয়ে এখন কোনো কমেন্ট করতে চাই না।’

জানতে চাইলে দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল) মঈদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন। চেয়ারম্যান থাকাকালে তাদের বিরুদ্ধে কেউ হয়তো কথা বলতে সাহস পাননি। এখন কথা বলার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কাজেই সাবেক দুদক চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও মামলা হতে পারে। তবে কমিশনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা অনভিপ্রেত। ‘সরষের ভেতর ভূত’ থাকলে তা অবশ্যই তাড়াতে হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধের দায়িত্ব যাদের, তারা নিজেরাই দুর্নীতিগ্রস্ত হলে কখনো দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব হবে না। হয়তো নিজেরা দুর্নীতিতে জড়িত বলেই রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি।’ 

সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন যুগান্তরকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ শাসনামলে দুদক স্বাধীনভাবে কাজ করেনি। দুদকের মূল কাজ সরকারি কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির অনুসন্ধান করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু দুদক সেটা না করে সরকারের প্রতিহিংসার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দিয়ে হয়রানি করেছেন। এসব ঘটনার তদন্ত হওয়া উচিত। তখন যারা কমিশনে দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের বিরুদ্ধে এখন তদন্ত করে ব্যবস্থা নিলে ভবিষ্যতে দুদকের দায়িত্বপ্রাপ্তরা স্বাধীনভাবে কাজ করবেন।’