Image description

‘দেশে শান্তি আসেনি। সব আগের মতোই রয়েছে। কারণে-অকারণে মানুষকে জীবন দিতে হচ্ছে। আমার মতো এখনও অনেক মায়ের বুক খালি হচ্ছে।’ রংপুরের পীরগঞ্জের বাবনপুর গ্রামের বাড়িতে বসে গতকাল মঙ্গলবার কথাগুলো বলছিলেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম।

কথা বলার ফাঁকে আক্ষেপ ঝরে পড়ে মনোয়ারা বেগমের কণ্ঠে, ‘আবু সাঈদের জীবন দিয়ে কি হলো? ছ্যোলটা হামার থাকাই ভালো আছিল। দেশ তো গঠনই হলো না। আগে যে রকম ছিল, ঠিক সে রকমই আছে।’

গত বছরের ১৬ জুলাই রংপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলি চালায় পুলিশ। পিছু না হটে বুলেটের সামনে হাত প্রসারিত করে বুক চিতিয়ে লড়ে প্রাণ দেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। এ ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলন ভিন্ন মাত্রা পায়। সারাদেশের ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে পতন ঘটে শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের।

আবু সাঈদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বাবা মকবুল হোসেন সমকালকে বলেন, ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র চারজন গ্রেপ্তার হয়েছে। বাকি সবাই বাইরে। সরকারের কাছ থেকে ছেলে হত্যার বিচারের দাবিটুকু পূরণ হয়নি।

আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘যে বৈষম্য দূর করার জন্য আমার ছেলে জীবন দিয়েছে, তা রয়েই গেছে। বিএনপি চায় শুধুই নির্বাচন (ইলেকশন)। আর জামায়াত-এনসিপি চায় বিচার। আমরা চাই এমন সরকার, যারা সুশাসন দেবে, বৈষম্য করবে না। দেশ শান্তিতে থাকবে।’

মকবুল হোসেন জানান, সরকার থেকে এককালীন ১০ লাখ টাকা তারা পেয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের মতো মাসিক ২০ হাজার টাকা ভাতার প্রতিশ্রুতির দেখা এখনও পাননি।
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে হারিয়ে এখনও অস্থিরতায় দিন কাটছে মায়ের। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে আবু সাঈদ ও তাঁর ছোট বোন সুমির মধ্যকার খুনশুটি। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে মনোয়ারা বেগম বলে চলেন, সুমিকে অনেক বেশি আদর করত আবু সাঈদ। সুমিও ভাই ছাড়া কিছু বুঝত না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি এলে সবার আগে সুমিকে ডাকত। সুমি যা খেতে চাইত, বাজার থেকে তা এনেই বিশ্রাম নিত। আমাকেও বলত, মা তোমার কী খেতে মন চাইছে? আমি কিনে আনব। কতদিন হয়ে গেল ভাই-বোনকে একসঙ্গে পাই না; খাওয়াতে পারি না। বাকি জীবন এ দুঃখ কুরে কুরে খাবে।

মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমার আবু সাঈদ জীবন দিয়েছে দেশ ও মানুষের শান্তির জন্য, ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য। আবু সাঈদের নামে এখন পর্যন্ত একটি মক্তবও হয়নি, যেখানে দোয়া করা হবে! গত এক বছরে দেশের কোনো পরিবর্তন হয়নি। কারণে-অকারণে মানুষকে জীবন দিতে হচ্ছে। এখনও আমার মতো অনেক মায়ের বুক খালি হচ্ছে। অনেক সন্তান বাবা, স্ত্রী হারাচ্ছে স্বামীকে।’

শাহাদাতবার্ষিকীতে নানা আয়োজন
আবু সাঈদের প্রথম শাহাদাতবার্ষিকী ও ‘জুলাই শহীদ দিবস’ উপলক্ষে আজ বুধবার বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নানা কর্মসূচি নিয়েছে। এর মধ্যে পীরগঞ্জের বাবনপুর গ্রামে শহীদ আবু সাঈদের কবর জিয়ারত, কালো ব্যাজ ধারণ ও শোক র‍্যালি। দিনভর কর্মসূচির মধ্যে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ আবু সাঈদ তোরণ ও জাদুঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন শহীদ আবু সাঈদ চত্বরে শহীদ আবু সাঈদ স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, আলোচনা সভা, চিত্রাঙ্কন প্রতযোগিতা, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল।

আলোচনা সভায় আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন প্রধান অতিথি থাকবেন। এ অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন অন্তর্বর্তী সরকারের চার উপদেষ্টা– অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও ফারুক-ই-আজম। এ অনুষ্ঠানে আরও ২১ শহীদ পরিবারের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

উপাচার্য অধ্যাপক শওকাত আলী বলেন, নিজের জীবন উৎসর্গ করে যে জাতিকে উদ্ধার করেন, তিনি সাধারণ কোনো মানুষ নন। আবু সাঈদের মহাকাব্যিক বীরত্বগাথা জাতি চিরদিন শ্রদ্ধাভরে মনে রাখবে। আমরা সামান্য আয়োজনের মাধ্যমে তার আত্মত্যাগকে সম্মান জানানোর পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের কাছে আন্দোলনের গুরুত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করব।