Image description

সদস্যরা কীভাবে নির্বাচিত হবেন– এ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য না হওয়ায় সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাবই বাদ যেতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যাতে ভবিষ্যতে কেউ বাদ দিতে না পারে, সে জন্য সংবিধানের বিশেষ কিছু অনুচ্ছেদ সংশোধনে গণভোটের বিধানে ঐকমত্য হয়েছে দলগুলোর। 

বিএনপিসহ পাঁচটি দল চায়, সংসদের নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন হবে। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ ২১ দল চায় ভোটের অনুপাতে (পিআর) হবে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন। দুই পক্ষের সমঝোতা না হওয়ায় উচ্চকক্ষের ধারণা পরিত্যক্ত করার আলাপ উঠেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে। 

কমিশন সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি অনানুষ্ঠানিকভাবে বলেছে উচ্চকক্ষের প্রস্তাব ‘পরিত্যক্ত’ করতে। কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আগামী সপ্তাহে সংলাপে উচ্চকক্ষের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। 

গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ১৪তম সংলাপে উচ্চকক্ষ ছাড়াও সংবিধান সংশোধন নিয়ে আলোচনা হয়। কমিশনের আগে প্রস্তাব ছিল, সংবিধান সংশোধনে সংসদের উভয় কক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং গণভোট লাগবে। উচ্চকক্ষ পিআর পদ্ধতিতে গঠিত হবে ধরে এ প্রস্তাব করেছিল কমিশন।

বিএনপিকে পিআরে রাজি করাতে সংবিধান সংশোধনে উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং সুনির্দিষ্ট বিষয়ে গণভোটের প্রস্তাব করেছে কমিশন। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, উচ্চকক্ষ না হওয়া পর্যন্ত সংবিধান সংশোধনে নিম্নকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং সুনির্দিষ্ট বিষয়ে গণভোট লাগবে। তবে উচ্চকক্ষ পিআর হলে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায়ও রাজি নয় বিএনপি।

আলোচনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সংসদের নিম্নকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংবিধান সংশোধনে কারও দ্বিমত নেই। আদালতের রায়ে গণভোটের বিধান ফেরত এসেছে। তাই সংবিধানের কোন বিষয়ে পরিবর্তনে গণভোট লাগবে, এ বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কেউ যাতে বাতিল করতে না পারে, সে জন্য এ বিষয়ে পরিবর্তনে গণভোটের বিধান রাখা যেতে পারে। জামায়াত এতে একমত বলে জানায়। 

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, বিদ্যমান সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অন্তর্ভুক্তির পর ভবিষ্যতে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গণভোটের প্রয়োজন হবে। 

গতকাল সকালের আলোচনায় উচ্চকক্ষের গঠন নিয়ে পঞ্চম দিনের মতো আলোচনা হয়। বিএনপির ৩১ দফায় উচ্চকক্ষ গঠনের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। উচ্চকক্ষ নিয়ে বিএনপির অবস্থান পরিবর্তনের দিকে ইঙ্গিত করে সংলাপের মধ্যাহ্ন বিরতিতে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, একটি দল বা তিনটি দল না চাইলে উচ্চকক্ষের আলাপ আটকে যাওয়াটা হবে অবিচার, বৈষম্য হবে। অধিকাংশ দল পিআর পদ্ধতির উচ্চকক্ষের পক্ষে। 

এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, বিএনপি এবং এর মিত্ররা পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনের বিরোধিতা করছে। এখন প্রস্তাবটিই আলোচনা থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করছে। মৌলিক সংস্কারে এনসিপি ছাড় দেবে না। 

সংলাপে অংশ নেওয়া ৩০ দল এবং জোটের সিপিবি ও বাসদ ছাড়া বাকিরা উচ্চকক্ষ গঠনের পক্ষে ছিল। এলডিপি উচ্চকক্ষের ৫০ আসন নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে এবং ৫০ আসন ভোটের অনুপাতে বণ্টনের প্রস্তাব করে। আলোচনায় জমিয়তে উলামায়ে ইসলামও আপাতত উচ্চকক্ষ চায় না।

ঐকমত্য না থাকায় উচ্চকক্ষের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ভার রাজনৈতিক দলগুলো কমিশনকে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন আলী রীয়াজ। নিজেদের মধ্যে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আগামী সপ্তাহে সিদ্ধান্তে আসা যাবে বলে আশা করছে কমিশন। 

আলী রীয়াজ বলেন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠিত না হলে অথবা গঠিত না হওয়া পর্যন্ত সংবিধান সংশোধনের জন্য সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগবে। তবে অনুচ্ছেদ ৮, ৪৮, ৫৬, ১৪২ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা (অনুচ্ছেদ ৫৮ক, ৫৮খ এবং ৫৮ঙ) সংশোধনে গণভোটের প্রয়োজন হবে। 

তত্ত্বাবধায়ক রক্ষায় গণভোট চায় বিএনপি
সংলাপের পর সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বিএনপি প্রস্তাব করেছে, ভবিষ্যতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হলে গণভোটের মাধ্যমেই করতে হবে, যাতে কেউ তত্ত্বাবধায়ক সরকারে হাত না দিতে পারে।

তিনি আরও বলেন, উচ্চকক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্য হয়নি। নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে না ভোটের অনুপাতে– এ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়েছে। সাধারণ বিল কীভাবে পাস হবে, সংবিধান সংশোধন কীভাবে হবে– এসব প্রশ্নে ব্যাপক আলোচনার ভিত্তিতে ঐকমত্য হয়নি। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রয়োজন আছে কিনা, সেই প্রশ্ন অনেক দল তুলেছে। দেশের যে আর্থিক সক্ষমতা, তাতে আরেকটি সংসদ সৃষ্টি করা এবং তা যদি নিম্নকক্ষের রেপ্লিকা হয়, তাহলে প্রয়োজন আছে কিনা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। সব বিষয়ে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন সবার মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত দেবে আগামী রোববার। এরপর বিএনপি মতামত জানাবে। 

গণভোটে বিরোধ নিষ্পত্তি চায় জামায়াত
গণভোটের মাধ্যমে সংস্কার সংলাপের মতবিরোধের নিষ্পত্তি চায় জামায়াত। ডা. তাহের বলেছেন, যদি কেউ সংস্কার বাধাগ্রস্ত করে, তাহলে একমাত্র পথ হচ্ছে গণভোট। জনগণই ঠিক করবে তারা কোন পদ্ধতি চায়, কোন সংস্কার চায়। 

তিনি জানান, পিআর পদ্ধতির উচ্চকক্ষ হতে হবে। যেখানে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোট অনুযায়ী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে। শুধু বড় দল নয়, ছোট দলগুলোর কণ্ঠ উচ্চকক্ষে থাকবে। 

সংবিধান সংশোধনে জামায়াতের অবস্থান সম্পর্কে তাহের বলেছেন, নিম্নকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ এবং উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে অনুচ্ছেদ ৮, ৪৮, ৫৬, ১৪২ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত বিধান সংশোধনে গণভোট লাগবে। 

গণভোট চায় এনসিপিও 
আখতার হোসেন বলেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, অনুচ্ছেদ ৪৮, ৫৬, নতুনভাবে সংযোজনযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কিত অনুচ্ছেদ যদি ভবিষ্যতে সংশোধন করতে হয়, তবে তা গণভোটের মাধ্যমে করতে হবে। সংবিধান সংশোধনের জন্য শুধু নিম্নকক্ষ নয়, উচ্চকক্ষেরও দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থনের বাধ্যবাধকতা থাকুক। 

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন্দ বলেন, পিআর না হলে আরেকটি গণঅভ্যুত্থান হবে। প্রহসনের নয়, আমরা কার্যকর গণভোট চাই। 

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, উচ্চকক্ষ নিয়ে কূলকিনারা পাওয়া গেল না। 

একই আহ্বান জানিয়ে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, গণভোটসহ মৌলিক কিছু বিষয়েও বিভিন্ন দল নানা মত দিয়েছে। সবাইকে এসব বিষয়ে একমত হতে হবে।