
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অন্যতম সুবিধাভোগী ও ঘনিষ্ঠ শিল্পগোষ্ঠী ইউনাইটেড গ্রুপের প্রতিষ্ঠান নেপচুন ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদে অনিয়ম, জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগ তুলে সরকারের একাধিক সংস্থায় আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির দুই পরিচালক ফরিদুর রহমান খান ও আবুল কালাম আজাদ।
তাদের পক্ষে ‘রহমান-রিজওয়ান অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’ আইন ফার্মের মাধ্যমে পাঠানো ওই নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন কর্তা-ব্যক্তি প্রতারণামূলকভাবে বোর্ড সভা আয়োজন করে অবৈধ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন এবং ভুয়া পরিচয়ে পরিচালকের দায়িত্ব দিয়ে জমি বিক্রির চেষ্টা করছেন।
নোটিশ অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর কোম্পানির বোর্ড সভায় মাত্র তিনজন পরিচালক উপস্থিত ছিলেন—মইনুদ্দিন হাসান রশিদ, খন্দকার মঈনুল আহসান এবং মালিক তালহা ইসমাইল বারি। অথচ কোম্পানির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, বৈধ বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হতে হলে কমপক্ষে চারজন পরিচালক উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক।
ফরিদুর রহমান খান ও আবুল কালাম আজাদ অভিযোগ করেন, তাদের সভার কোনো আমন্ত্রণ জানানো হয়নি এবং তারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। অথচ সেই সভাতেই নিজামুদ্দিন হাসান রশিদকে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, যা নোটিশে ‘অবৈধ ও জালিয়াতিপূর্ণ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
আইনি নোটিশে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান মইনুদ্দিন হাসান রশিদ, পরিচালক খন্দকার মঈনুল আহসান এবং নতুনভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত নিজামুদ্দিন হাসান রশিদ বিভিন্ন সাব রেজিস্ট্রার অফিসে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য উপস্থাপন করে কোম্পানির জমি বিক্রি বা বন্ধক দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
নোটিশে বলা হয়, ‘এই সমস্ত জমির দলিল যদি নিজামুদ্দিন হাসান রশিদের স্বাক্ষরে সম্পাদিত হয়—তবে তা শুরু থেকেই বাতিলযোগ্য (void ab initio) হবে। এতে সাধারণ ক্রেতারা মারাত্মক আইনি জটিলতায় পড়বেন।’
জানা গেছে, ২০২৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে কোম্পানির ছয়জন পরিচালক যথাক্রমে— মইনুদ্দিন হাসান রশিদ, খন্দকার মঈনুল আহসান, ফরিদুর রহমান খান, আবুল কালাম আজাদ, মালিক তালহা ইসমাইল বারি এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসির উদ্দিন আক্তার রশিদ উপস্থিত থাকার কথা ছিল। তবে ওই বছরের ২৫ নভেম্বর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসির উদ্দিন আক্তার রশিদ মারা যান। ফলে পাঁচজনকে নিয়ে বোর্ড সভা হওয়ার কথা থাকলেও তাতে শুধুমাত্র তিনজন পরিচালক উপস্থিত ছিলেন।
যারা হলেন—মইনুদ্দিন হাসান রশিদ, খন্দকার মঈনুল আহসান ও মালিক তালহা ইসমাইল বারি। অথচ কোম্পানিটির আইন অনুযায়ী বৈধ বোর্ড মিটিংয়ের জন্য সর্বনিম্ন ৪ জন পরিচালক উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু ফরিদুর রহমান খান ও আবুল কালাম আজাদ—এই বৈঠকের কোনো আমন্ত্রণ পাননি এবং সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। দুই পরিচালকের অনুপস্থিতিতে তিনজনের ওই বোর্ড সভায় নিজামুদ্দিন হাসান রশিদকে ম্যানেজিং ডিরেক্টর (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ তিনি তখনো নেপচুন ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের বৈধ পরিচালক নন। তার নিয়োগকে (নিজামুদ্দিন হাসান রশিদ) ‘জালিয়াতি ও অবৈধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে আইনি নোটিশে বলা হয়েছে, এটি সম্পূর্ণরূপে কোম্পানির গঠনতন্ত্র ও আইন লঙ্ঘন করেছে।
প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হয়েও অফিসে ঢুকতে না দেওয়ার অভিযোগ
ফরিদুর রহমান খান ও আবুল কালাম আজাদ জানান, ২০২৩ সালের শুরু থেকেই তাদের কোম্পানির অফিসে প্রবেশে বাধা দেওয়া হচ্ছে এবং বোর্ড সভায় অংশগ্রহণ থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে। অথচ তারা দুজনই কোম্পানির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং বড় শেয়ারহোল্ডার, যাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে ২৭৫০টি করে শেয়ার।
সরকারি দপ্তরে সতর্কবার্তা ও হস্তক্ষেপের আহ্বান
নোটিশটি পাঠানো হয়েছে ঢাকা বিভাগীয় রেজিস্ট্রার অফিসসহ তেজগাঁও, বাড্ডা, খিলগাঁও ও গুলশান সাব রেজিস্ট্রার অফিসে। সেখানে স্পষ্টভাবে অনুরোধ করা হয়েছে, নিজামুদ্দিন হাসান রশিদের মাধ্যমে জমি সংক্রান্ত কোনো দলিল স্বাক্ষর বা নিবন্ধন যেন না করা হয়।
এছাড়া বলা হয়েছে, ‘নেপচুন ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের পক্ষ থেকে যদি মিথ্যা ও জাল নথি উপস্থাপন করা হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি এবং দেওয়ানি উভয় ধরনের আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
ক্রেতাদের জন্য সতর্কবার্তা
আইনি নোটিশে সাধারণ জমি ক্রেতাদের সতর্ক করে বলা হয়, কোম্পানির নামে যদি কেউ জমি কিনে থাকেন, তা হলে ক্রয় দলিলের স্বতঃসিদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। এতে ভবিষ্যতে বিপুল আর্থিক ক্ষতি ও দীর্ঘমেয়াদি আইনি জটিলতায় পড়তে পারেন তারা।
আইনজীবীরা বলছেন, যারা নেপচুন ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের সঙ্গে জমি বা সম্পত্তি কেনাবেচায় আগ্রহী, তাদের যথাযথ যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আইন অনুযায়ী পরিচালক নিযুক্ত না হলে তার স্বাক্ষরে সম্পাদিত দলিলের কোনো বৈধতা থাকে না।
অভিযোগ বিষয়ে জানতে ফোন করা হয় ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান মইনুদ্দিন হাসান রশিদকে। তবে তিনি প্রশ্ন শুনে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে আরও যত অভিযোগ
ইউনাইটেড গ্রুপ নির্মিত ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উত্তর পাশে গড়ে ওঠা একাধিক সুউচ্চ ভবন জাতীয় নিরাপত্তায় বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেপিআই নীতিমালা ভেঙে এসব ভবন নির্মিত হলেও বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) কীভাবে অনুমতি দিয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ১২-১৩ তলা হোটেল, শপিং মল, অফিস ও পার্কিং কমপ্লেক্স এসব ভবন থেকে বিমানবন্দরের স্পর্শকাতর স্থানগুলো দৃশ্যমান হওয়ায় যেকোনো ধরনের নাশকতার ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইউনাইটেড ও সামিট গ্রুপ প্রকল্পটির মালিকানা নেয় এবং ২০১১ সালে পুনরায় নির্মাণকাজ শুরু করে। কাগজপত্রে ২০১৭ সালে কেপিআই অনুমোদনের কথা বলা হলেও তার কোনো লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি, এমনকি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও তা জানে না বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে প্রকল্পটিকে ঘিরে দুর্নীতি, অনিয়ম ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে।
রাজউকের নিয়ম ভেঙে ভাটারার মাদানী এভিনিউতে ইউনাইটেড গ্রুপ পাঁচতলা একটি বিশাল ভবন নির্মাণ করেছে। রাজউকের পক্ষ থেকে নোটিশ দেওয়া হলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তারা কোনো জবাব দেয়নি, যা তাদের অনিয়মের প্রমাণ বলে মনে করা হচ্ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ইউনাইটেড গ্রুপ প্রায় ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়েছে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তারাও ব্যক্তি পর্যায়ে ৪০ কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ। এ ছাড়া ২০২৩ সালের জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকারকে সহযোগিতার অভিযোগও রয়েছে এই গ্রুপের বিরুদ্ধে। এমনকি আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত বাহাদুর হোসেন মনির হত্যা মামলায় ইউনাইটেডের শীর্ষ কর্তাদের নামও আসামির তালিকায় রয়েছে।
একই সময়ে ইউনাইটেড হাসপাতাল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে, যা প্রতিষ্ঠানটির রাজনৈতিক পক্ষপাত এবং মানবিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
ইউনাইটেড গ্রুপ বিদ্যুৎ খাতে একপ্রকার মাফিয়াচক্রে পরিণত হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সব ধরনের নিয়ম-নীতি ও এমনকি হাইকোর্টের আদেশ উপেক্ষা করেই তারা এখনো দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনা করছে। ঢাকা ইপিজেডে ৮৬ মেগাওয়াট এবং চট্টগ্রাম ইপিজেডে ৭২ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দুটি বর্তমানে কোম্পানিটির জন্য মোটা অঙ্কের মুনাফার উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউনিটপ্রতি খরচ যেখানে ৪ টাকা ১৭ পয়সা, সেখানে সেই বিদ্যুৎ ১০ টাকা ৮৮ পয়সা বা তারও বেশি দামে বিক্রি করছে ইউনাইটেড গ্রুপ। এই অস্বাভাবিক দামে বিদ্যুৎ বিক্রির ফলে সাধারণ গ্রাহকদের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের ছত্রছায়ায় এই প্রতিষ্ঠানটি একাধারে নিয়ম লঙ্ঘন, দাম বাড়তি আদায় এবং নৈতিকতা বিবর্জিত ব্যবসায়িক আচরণ চালিয়ে গেলেও এর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে না।
ঢাকাটাইমস