
রাজধানীর পুরান ঢাকায় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের (মিটফোর্ড হাসপাতাল) ৩ নম্বর গেটের সামনে ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে মো. সোহাগকে (৩৯) নৃশংসভাবে হত্যার সময় ১০০ গজ দূরে আনসার ক্যাম্পের অবস্থান থাকলেও বাহিনীর কারও তাঁকে বাঁচাতে এগিয়ে না আসা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও রাজনৈতিক পরিসরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা সরকারের ব্যর্থতার কথা বলা হচ্ছে।
আজ রোববারও জাতীয় পার্টির মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী রংপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে সোহাগকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। সেখানে থেকে ১০০ গজের মধ্যে আনসার ক্যাম্প ছিল; আনসারদের হাতে অস্ত্রও ছিল। কিন্তু কেউ তাঁকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেননি। অর্থাৎ বর্তমান সরকার পুলিশ প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছে না। সরকারের সঙ্গে প্রশাসনের সমন্বয় দেখা যাচ্ছে না, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয় দেখা যাচ্ছে না।
তবে এ ঘটনায় আনসার সদস্যদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা বা দায় ছিল না বলে মনে করেন বাহিনীর মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ। তিনি বলেছেন, ঘটনার দিন আনসার সদস্যরা হাসপাতালের নির্ধারিত রোস্টার অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করেছেন। রোস্টার অনুযায়ী হাসপাতালের গেটের বাইরে স্বপ্রণোদিত হয়ে আনসার সদস্যদের দায়িত্ব পালনের সুযোগ ছিল না।
আজ বিকেলে খিলগাঁও সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে আনসার সদস্যদের দায়িত্ব পালনের পরিধি ও রোস্টার তুলে ধরে মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ জানান, সোহাগ হত্যার ঘটনা হাসপাতালের তিন নম্বর গেটে। সেদিন সকাল ৬টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত ৩ নম্বর গেটে রোস্টার অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করেছেন একজন আনসার সদস্য। এরপর সেখানে আনসার সদস্যের উপস্থিতি ছিল না। হাসপাতালে মোট নিয়োজিত আনসার সদস্যের সংখ্যা ৮০ জন। তাঁদের মধ্যে রোস্টার অনুযায়ী, সকাল ৬টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত ২৪ স্পটে দায়িত্ব পালন করেন ২৫ জন আনসার সদস্য।
আনসার ডিজি বলেন, হাসপাতালের কোথায় ও কীভাবে আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন—সেটা নির্ধারণ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তথা ডিরেক্টর ও ডিডি (প্রশাসন)। সোহাগ হত্যার ঘটনা বিকেল ৫টা ৫০ মিনিটে। তখন ঘটনাস্থল ৩ নম্বর গেটে দায়িত্ব পালন অবস্থায় কোনো আনসার সদস্যকে রাখেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সুতরাং সোহাগ হত্যার ঘটনায় আনসার সদস্যদের অবহেলা বা ব্যত্যয় দেখার কোনো সুযোগ নেই।
৯ জুলাই স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩ নম্বর গেটসংলগ্ন এলাকায় এক হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ নামের এক ব্যবসায়ী স্থানীয় একদল সন্ত্রাসীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তাঁর শরীরের ওপর ভারী পাথর ফেলে তাঁকে হত্যা করা হয়।
মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ বলেন, ঘটনার সময় শত শত লোক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ ভিডিও করছিলেন, কেউ কিন্তু নিকটস্থ আনসার ক্যাম্পে খবর দেননি, কল করেননি। কেউ ক্যাম্পে গিয়ে ঘটনা সম্পর্কে বলেননি। শুধু তা-ই নয়, হাসপাতালের আনসারের প্লাটুন কমান্ডারকেও জানাননি। যখন প্লাটুন কমান্ডার খবর পেয়েছেন, তখন তিনি ঘটনাস্থলে দৌড়ে আসেন, তখন ভুক্তভোগীর বুকের ওপরে উন্মত্ততা চলছিল। তখন তিনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে খবর দেন, বলা হয়, গেটের বাইরে এ রকম একটা ঘটনা ঘটছে। এরপরই ভিকটিমকে টেনে গেটের ভেতরে নেওয়া হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। হাসপাতালের বাইরের ঘটনা বলে আনসারকে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।
আবদুল মোতালেব আরও বলেন, আনসারের দায়িত্ব দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকায় সাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু ৩ নম্বর গেট এলাকায় তখন সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা ছিল না। তখন রোস্টার অনুযায়ী, আনসার সদস্যদের ডিউটিও ছিল না। তাহলে আনসার সদস্যদের দায়িত্বে অবহেলা কোথায়? কেউ তো খবর দেননি। যতক্ষণে প্লাটুন কমান্ডার খবর পেয়েছেন, ততক্ষণে ‘টু লেট’, ঘটনা শেষ! তা ছাড়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও কোনো ব্যবস্থা নিতে বলেনি।
আনসার বাহিনীর প্রধান বলেন, ‘এই মর্মান্তিক ঘটনায় দেশের প্রত্যেক সচেতন নাগরিকের মতো বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ৬১ লাখ সদস্য গভীরভাবে শোকাহত। আমরা নিহত ব্যক্তির বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। তবে এ ঘটনার পর আনসার সদস্যদের দায়িত্ব পালনে অপেশাদারত্বের অভিযোগ তোলার সুযোগ নেই।’
তিনি বলেন, আনসার সদস্যরা কীভাবে দায়িত্ব পালন করবেন, তার রেসপন্সিবিলিটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নির্দেশনা না দিলে আনসার সদস্যরা স্বপ্রণোদিতভাবে যাওয়ার সুযোগ নেই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ডিরেশনই ছিল, গেটের বাইরের ঘটনায় আনসার সদস্যদের যাওয়ার সুযোগ নেই।
আনসার সদস্যদের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছাড়া পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ আছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে ডিজি বলেন, হাসপাতালের ডিরেক্টরের নির্দেশনাই মানবে আনসার। হাসপাতালের ভেতরে যদি ঘটত, তাহলে সেলফ ডিফেন্স হিসেবে আনসার সদস্যরা নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করবেন। কারণ, আনসারের কাজই কর্তব্যরত এরিয়ায় সিভিলিয়ানদের নিরাপত্তা দেওয়া। তারা (হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ) যেভাবে নির্দেশনা দেয়, সেভাবেই দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে রোস্টার, কর্তব্যরত এরিয়ার বাইরে আনসার সদস্যদের যাওয়ার সুযোগ ছিল না।
আনসার বাহিনীর প্রধান বলেন, ‘আমরা নানা সময় পরিদর্শন করি, নিরাপত্তা ইস্যুজ দেখি, পরামর্শ দিই। সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের কথা বলি। আমরা যদি কোথাও নিরাপত্তা ইস্যুজ দেখি, তখন জানাই। দায়িত্ব পালনে সমস্যা হলে আমরা আনসার ডিপ্লয়মেন্ট প্রত্যাহারও করি। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সেটা পারি না। যদি সেটা পারতাম, তাহলে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে আনসার সদস্যদের প্রত্যাহার করে নিতাম।’
সোহাগ হত্যার ঘটনায় বিশেষ কিছু দিক
আনসার বাহিনীর প্রধান বলেন, এখানে উল্লেখ্য যে, আনসার বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা সূত্রে জানা যায়—
১. স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে আনসার সদস্যদের দায়িত্ব ও দায়িত্বের স্থান নির্ধারণ, রোস্টার তৈরি ও তদারকি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, বিশেষত একজন উপপরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তার ওপর ন্যস্ত। আনসার সদস্যরা হাসপাতালের নির্ধারিত রোস্টার অনুযায়ী কাজ করেন।
২. আনসার সদস্যদের দায়িত্ব পালনের জন্য অনুমোদিত শটগান থাকলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁদের নিরস্ত্র অবস্থায় ডিউটি করতে নির্দেশ দেয়, যা যেকোনো ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।
৩. সোহাগ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় বিকেল ৫টা ৫০ মিনিটে। অথচ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের রোস্টার অনুযায়ী বেলা ২টার পর ৩ নম্বর গেটে কোনো আনসার সদস্যের ডিউটি ছিল না। বিষয়টি আগেও একাধিকবার কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হলেও তারা রোস্টার সংশোধনে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তাই এ সময় গেটে আনসার সদস্য অনুপস্থিত থাকায় হত্যাকাণ্ডে তাঁদের ওপর দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। পরে ঘটনাত্তোর তথ্য প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে পরিচালককে অবহিত করা হলেও গেটের বাইরে ঘটনা হিসেবে তিনি তা আমলে নেননি।
৪. তিন নম্বর গেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না, যা নিরাপত্তাঝুঁকি বাড়িয়েছে। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানানো হলেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
৫. হত্যাকাণ্ড সংঘটিত স্থানটি আনসার ব্যারাকের যাতায়াতের গেট থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে এবং ব্যারাকের অবস্থানগত কারণে সেখান থেকে ঘটনা দেখতে পারা অসম্ভব। উল্লেখ্য, ওই একটিমাত্র গেট ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা থেকে ঘটনাস্থলে যাওয়া যায় না। ঘটনাস্থলটি ব্যারাকের পেছনের দিকের অংশ হওয়ায় দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা ঘটনাটি সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে জানতে পারেননি। এ ছাড়া শত শত মানুষের সামনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের শেষ ভাগে গেটের বাইরে হওয়ায় কোনো প্রকার সাহায্যের খবরও তাৎক্ষণিকভাবে কাউকেই জানাননি। তাই অঙ্গীভূত আনসারদের ভূমিকা রাখার সুযোগই হয়নি।
মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ বলেন, ‘এমন প্রেক্ষাপটে, যেখানে আনসার সদস্যদের ব্যারাক থেকে কেউ তাদের খবর দেয়নি বা তাদের সামনে ঘটনা ঘটেনি, সেখানে দায়িত্বে অবহেলার প্রশ্নই ওঠে না। একটি পেশাদার বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে এ ধরনের ভিত্তিহীন অভিযোগ ও অপপ্রচার দুঃখজনক ও গভীরভাবে হতাশাজনক।’