
‘বাবা, আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না, তুমি আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।’ এই চিঠিটি লিখেছিল ছোট্ট মেয়ে তুবা তার বাবার জন্য। স্কুলের অ্যাসাইনমেন্ট ছিল ‘বাবাকে নিয়ে একটি চিঠি’। শিশুসুলভ লেখা, কাঁচা হাতে আঁকা একটা ভালোবাসার চিত্র—যা আর কোনোদিনই চোখে পড়েনি বাবার। কারণ, সেই বাবা—রিয়াজুল ইসলাম ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।
বরগুনার বালিয়াতলী ইউনিয়নের উরবুনিয়া গ্রামের সন্তান রিয়াজুল ইসলাম ছিলেন পোশাকশিল্পের কর্মী। সাভারের বাইপালে অবস্থিত প্রীতি গ্রুপে ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতেন। পরিবার নিয়ে থাকতেন রাজধানীতে। শান্ত, পরিশ্রমী মানুষটি আন্দোলনের সময় বেরিয়ে গিয়েছিলেন শুধু দেশটাকে একটু ভালো দেখার আশায়। কিন্তু আর ফিরেননি।
৫ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত স্বামীর সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ ছিল মরিয়মের। বারবার ফোন করেও যখন কোনো উত্তর আসে না, তখন থেকেই উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে। সন্ধ্যায় খবর আসে—সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অজ্ঞাত পরিচয়ের একজন গুলিবিদ্ধ পুরুষের মরদেহ রাখা আছে। ছবি দেখে নিশ্চিত হন—এটাই তার রিয়াজুল।
মোসা. মরিয়ম, রিয়াজুলের স্ত্রী, কান্নাভেজা গলায় বলেন, ‘বিজয়ের দিনটাকে আমরা উদযাপন করব ভেবেছিলাম। সে তো রাতে এসে বলেছিল—কাল তো ছুটির দিন, মিছিলে যাব। কেউ তো জানতো না—এই আনন্দই হবে আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় শোক। বিজয়ের দিন, ‘আমার স্বামী বিজয়ের স্বপ্ন নিয়ে ঘর ছেড়েছিলেন, ফিরলেন লাশ হয়ে’ ।
তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। শুধু একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে রাস্তায় নেমেছিলেন। আর সেখানেই গুলিতে মারা গেলেন। আমার একমাত্র মেয়েটা রোজ রাতে ঘুমাতে চায় না, বলে—বাবা তো আমাকে নিয়ে ঘুমাতো।’
রিয়াজুলের মৃত্যু মানে শুধু একজন মানুষের মৃত্যু নয়, ছিল এই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটির প্রস্থান। একদিকে প্রতিবন্ধী শাশুড়ি, অন্যদিকে একমাত্র শিশু কন্যা তুবা। সব দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন স্ত্রী মরিয়ম। কিন্তু কাজ বলতে কিছুই নেই। জীবন এখন শুধুই প্রশ্নের মুখোমুখি। এই সংসার আমি কীভাবে চালাব? তুবার মুখে হাসি কীভাবে ফিরিয়ে আনব?—প্রতিটি বাক্যে যেন বেদনার ভার।
তিনি আরও বলেন, ‘তুবা বাবাকে অনেক ভালোবাসতো। সেই বাবার জন্য লিখে রেখেছিল একটা চিঠি। স্কুল থেকে কাজ দিয়েছিল—‘বাবার উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লেখো’। কী আশ্চর্য, বাবা সেই চিঠি আর কোনোদিন পড়ল না।’
স্ত্রী মরিয়ম বলেন, ‘আমার স্বামী দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। আমি চাই, তাকে রাষ্ট্রীয় শহীদের মর্যাদা দেয়া হোক। সেই সঙ্গে আমার মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য যেন কোনো সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়। আমরা কেউ কিছু চাই না, শুধু চাই মেয়েটা যেন তার বাবার অভাব না টের পায়।’ আমার মেয়ে তুবা এখনো বাবার শার্ট গায়ে জড়িয়ে রাখে। ছোট্ট হাতে আঁকা বাবার ছবিগুলো দেয়ালে টাঙানো। প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে বলে, ‘বাবা, আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।’
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে থামাতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপীড়ন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।