Image description

বাংলাদেশে একের পর এক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ব্যর্থ হলে, জনমনে, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের মধ্যে প্রবল হতাশা তৈরি হয়। তখন শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারকে যথাযথভাবে চিত্রিত এবং এর মিথ্যা বয়ানগুলোকে পরাজিত করা জরুরি হয়ে পড়ে। সেই প্রয়াসে তার শাসনামলের অন্তত শ'খানেক অপকর্ম, কুকর্ম এবং দুস্কর্মের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়।

ফ্যাসিবাদী জামানায় দেশের ভেতরে অবস্থান করে এ ধরনের আলোচনা বিপজ্জনক ছিল বলে সামাজিক নেটওয়ার্কে নির্দিষ্ট কিছু গণতান্ত্রিক চেতনার মানুষের সাথে শেয়ার করা হয়। উদ্যোগটি যেহেতু নেওয়া হয় জুলাই বিপ্লবের আগেই, তাই ২০২৪-এর হত্যাকাণ্ড এবং নিষ্ঠুরতা এ তালিকায় প্রতিফলিত হয়নি।

তবুও তালিকাটি লম্বা এবং ভাবলে অবাক হতে হয়- সত্যিই এতো খারাপ কাজ হয়েছে! শেখ হাসিনা ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের এই সমস্ত অপরাধের বিষয়ে তার ধামাধরা গণমাধ্যম জনমত তৈরি না করে বরং বিপরীত বয়ান প্রচার করেছে। ফ্যাসিবাদী শাসন ক্ষমতার ঔদ্ধত্যে হাসিনা বলতেন এবং ৫ আগস্ট ২০২৪-এ ক্ষমতা ছেড়ে পলায়নের পরও তাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি জানি না, আমার কী অপরাধ!’

তার পতনের এক বছর পর তার ‘না জানা’ অপরাধের এই তালিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য- গত বছর জুলাই-আগস্টের ঘটনা প্রবাহের আগের প্রায় দেড় দশকে তার সরকার দেশ ও জাতির কী সর্বনাশ করেছিল; তা নিজেদেরকে নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেওয়া; একটু বোঝার চেষ্টা করা, কেন বাংলাদেশের জনগণকে একটি রক্তাক্ত বিপ্লবের মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পথ বেছে নিতে হয়েছিল। তাহলে দেখা যাক কী অপরাধ তিনি করেননি।

জাতীয় নির্বাচনে ‘সূক্ষ্ম’, ‘স্থুল’ সব ধরনের কারচুপিতে হ্যাট্রিক করেন তিনি। ২০০৮-এর আঁতাতের নির্বাচন বাদ দিলেও হাসিনা তিন তিনটি জোচ্চুরির নির্বাচনে নেতৃত্ব দেন; ছল-বল-কৌশলে ২০১৪-র একতরফা নির্বাচন, প্রশাসনিক ডাকাতির মাধ্যমে ২০১৮-এর নৈশকালীন ভোট এবং ফ্যাসিবাদী কায়দায় ২০২৪-এর ডামি নির্বাচন অনুষ্ঠান করে ক্ষমতা ধরে রাখেন।

প্রতিহিংসাপরায়ণ এই আওয়ামী লীগ নেত্রী অতীতে তার নির্বাচনী হারের প্রতিক্রিয়ায়, প্রতিদিন মানুষের অধিকার হরণ এবং জনগণের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন।

তার একক ইচ্ছায় ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত ও ধারাবাহিকভাবে নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়। সংসদ, স্থানীয় সরকার ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদ আত্মীয়, দলীয় অপদার্থ অনুগত এবং মাফিয়াদেরকে উপহার দেওয়া হয়।

১৯৯০-এর দশক থেকে গণতান্ত্রিক পরিচিতি পাওয়া একটি রাষ্ট্রের সম্মান বিদেশে ভূলুন্ঠিত হয়; অগণতান্ত্রিক দেশের তালিকায় স্থান পায় বাংলাদেশ। জনগণের ভোটাধিকার হরণ করা অবৈধ প্রধানমন্ত্রী হাসিনা নির্লজ্জভাবে বলেন, মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনি।

তার দলবলের চেতনার অংশ হিসেবেই সরকারের মন্ত্রীরা (ইনু, নাসিম, কাদের, হাসান) প্রকাশ্যে কথা বলেন গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারের বিপক্ষে।

গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন করার জন্য ২০১৪-১৫-তে পুলিশ ও গোয়েন্দা দিয়ে আগুন সন্ত্রাস করে নিরীহ মানুষ খুন করে। বিরোধী নেতাকর্মী ও নিরপরাধ মানুষকে বলপূর্বক গায়েব করা ও ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন ঘিরে কয়েক লাখ মিথ্যা মামলার রেকর্ড হয়।

হেফাজতে ইসলামের শাপলা চত্বর সম্মেলনে ২০১৩ সালের মে মাসে কয়েক শত ঘুমন্ত শিশুকে হত্যা করা হয়। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই বিডিআর বিদ্রোহের আড়ালে ৫৭ জন সামরিক কর্মকর্তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।

দেশের নির্বাচনে সরাসরি বিদেশি হস্তক্ষেপ দেখা যায়; ভারতের বিদেশ সচিব সুজাতা সিং জেনারেল এরশাদকে ২০১৪-এর একতরফা নির্বাচনে যেতে চাপ প্রয়োগ করেন।

ক্ষমতায় থাকার জন্য পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশের ওপর বিদেশি স্বার্থের প্রাধান্য দেন হাসিনা। তিনি প্রতিবেশী ভারতকে কত বেশি ছাড় দিয়েছেন তা নিয়ে গর্ব করেন।

কী আশ্চর্য স্বাধীনতার চেতনার দোহাই দিয়ে বাংলাদেশকে বানানো হয় একটি তাবেদার রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশীদেরকে ‘নিজ বাসভূমে পরবাসী’!

মাশুল ছাড়াই প্রতিবেশী দেশকে ট্রানজিট দেওয়া হয়; তারপরও যৌথ নদীর পানি বঞ্চিত থাকে বাংলাদেশ এবং বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি, মাদক পাচার ও সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয় না।

বিদেশি শক্তির কাছে নিজের প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখতে হাসিনা নানা সময়ে জঙ্গি অভিযানের নাটক ও নির্বিচারে নিরপরাধ মানুষ হত্যা করেন। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে গুম, খুন, জেল-জুলুমের মাধ্যমে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়। উত্তর কোরিয়ার আদলে এবং দুর্নীতিগ্রস্ত একটি পারিবার-কেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন ও প্রতিষ্ঠা করা হয়।

জনগণের সেবকদের বানানো হয় শাসক আর ঘুষ ও অন্যায় সুবিধা দেওয়া ও নেওয়া হয় সেই শাসনের মূলনীতি। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে চামচা ও দুর্বৃত্তদের নিয়োগ দেওয়া হয়, আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের ভূমিকা পালন করেন করদাতাদের অর্থে বেতন পাওয়া পুলিশ ও সামরিক-বেসামরিক আমলারা। তাদের সীমাহীন বাড়াবাড়ি, ব্যাপক নৈতিক অপরাধ সংঘটন ও দুর্নীতির তথ্য চাপা দিতে চেয়েও ফাঁস হয়। 

সাবেক সেনাপ্রধান আজিজসহ অনেকের অন্যায়/অপরাধমূলক কথোপকথন ফাঁস হওয়ার পরও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

পুলিশ ও র‌্যাব কর্মকর্তাদের মার্কিন কালো তালিকাভুক্তির পরও কোনো ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয় হাসিনা সরকার।

জনপ্রতিনিধিত্ব ও ন্যায়বিচারের পরিবর্তে হাসিনা-কেন্দ্রিক একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর (অলিগার্কি) জন্য রাষ্ট্রকে উৎসর্গ করা হয়।

সচিবালয়, শহরের প্রাণকেন্দ্র ও মহাসড়কসহ দৃশ্যমান স্থানসমূহে শাসক দলীয় পোস্টার প্রদর্শনী চলে। যে কোনো ফ্যাসিস্ট শাসকের প্রচারণার মতোই তার সময়ে পাঠ্য বইয়ে শ্লোগান লেখা হয়েছে, 'শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।

আচরণে বনি ইসরাইলি শিশু ঘাতক ফেরাউন আর পররাষ্ট্র সম্পর্কে সিকিমকে পরাধীন বানানো লেন্দুপ দর্জির প্রতিমূর্তি হিসেবে আবির্ভাব ঘটে হাসিনার।

গণতন্ত্র হত্যা ও দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে, উন্নয়নের নামে জনগণকে বোকা বানানোর অপচেষ্টা ও জাতীয় সম্পদের নির্বিচার লুণ্ঠন করা হয়।

বড় প্রকল্প ও জনকল্যাণের নামে বাংলাদেশের জণগণের ওপর কয়েক প্রজন্মের ঋণের বোঝা চাপানো হয়।

তার শাসনে জীবনযাত্রার ব্যয় আকাশছোঁয়া, সাধারণ মানুষের রোজগার সীমিত, সবক্ষেত্রে বৈষম্য বৃদ্ধি এবং জাতীয় অর্থনীতির সর্বনাশ ঘটে। কোম্পানি/ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কমিশন/ঘুষের বিনিময়ে দ্রব্যমূল্য বাড়তে দেওয়া হয়।

জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করার খায়েসে তার সরকার শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস এবং শিক্ষাঙ্গনে মুক্ত চিন্তার অবসান ঘটায়। 

সর্বত্র ছাত্রলীগের মাস্তানিতে শিক্ষা ও ছাত্র রাজনীতির পরিবেশ নষ্ট হয়।

কার্যত হাসিনার সর্বগ্রাসী একনায়তান্ত্রিক শাসনে কোনো নাগরিকের বড় চিন্তা করার সুযোগ শূন্য করা হয় (মানুষ যেন হয়ে পড়ে বনসাই)। বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষে কথা বলার অপরাধে তার ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে হত্যা করে।

তরুণদের জন্য স্বাধীনতা, সুশিক্ষা, সুযোগ ও নীতিবিবর্জিত এক ভীতিকর রাষ্ট্রের গোড়া পত্তন করা হয়। মেধা নয়, আওয়ামী আনুগত্যই হয়ে পড়ে সরকারি-বেসরকারি নিয়োগের প্রধান মানদণ্ড এবং কোটা ব্যবস্থার মাধ্যমে তা নিশ্চিত করা হয়।

সম্ভাবনাময় তরুণদের দেশ ছাড়ার প্রতিযোগিতা ও সাগরে বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর মিছিল দেখা যায়।

যখন অনেক বাংলাদেশি যোগ্যতার সঙ্গে উন্নত বিশ্বে চাকরি করে, তখন দেশে অধিক বেতনের চাকরির সুযোগ দেওয়া হয় বিদেশিদের, বিশেষ করে একটি প্রতিবেশী দেশের অযোগ্য নাগরিকদের।

অন্যদিকে, নোবেল পুরস্কারের দুরাশায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার পর তাদেরকে মিয়ানমারে ফেরত না পাঠিয়ে বাংলাদেশকে বিপদগ্রস্ত করে ফেলা হয়। কোনো কোনো দেশ সম্পর্কে প্রকাশ্যে তোষণ নীতি আবার অন্য দেশ নিয়ে কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত মন্তব্য, এমনকি রাষ্ট্রদূতদের আক্রমণ তার পররাষ্ট্র নীতির নমুনা।

সস্তায় বিশ্ব রেকর্ড করতে চাওয়া হাসিনা অবশ্য তা অর্জন করেছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শিল্প দুর্ঘটনায় রানা প্লাজা ধসে যায় ২০১৩ সালে; ভবনের মালিক তার দলের কর্মী। বাংলাদেশ ব্যাংকে পৃথিবীর বৃহত্তম সাইবার ডাকাতি ঘটে ২০১৬ সালে। 

তার শাসনামলে ব্যাংক খাতে রেকর্ড কেলেঙ্কারি ও ৭০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। ২০১৭ সালে গোয়েন্দা দিয়ে ইসলামী ব্যাংক দখল করা হয়।

হলমার্ক ঋণ জালিয়াততে সোনালী ব্যাংকের চার হাজার কোটি টাকা গায়েব হয়। বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িত আসল রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের আড়াল করা অথবা দায়মুক্তি দেওয়া হয়।

নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের দেশ-বিদেশে কষ্টার্জিত অর্থ যাতে অনুগতদের হাতে চলে যায়, সেজন্য বাজার ও প্রশাসনিক আয়োজন নিশ্চিত করা হয়। এক পর্যায়ে ডলার সংকট তৈরি হয়। তার আগে, ডেসটিনি, ই-ভ্যালি ও অন্যান্য কেলেঙ্কারিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

তিনি ক্ষমতায় এলেই শেয়ার মার্কেটে ধস নামে (১৯৯৬ ও ২০১০-১১)। দুই দফায় এবং পরবর্তীতেও অন্তত ৪০ হাজার কোটি টাকা লুট হয়।

বিদ্যুৎ খাত থেকে কুইক রেন্টাল ও আমদানি চুক্তির সুযোগে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয় (এক বছরেই ১৭,০০০ কোটি টাকা)। জনগণ ও শিল্প পর্যায়ে বিদ্যুত ও গ্যাস সরবরাহ সমস্যা এবং দাম বাড়ে।

দশ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতু প্রকল্প (রেলসহ) ৭০ হাজার কোটি টাকা বানানো হয়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের খরচ দ্বিগুণ করে ১৪ বিলিয়ন ডলার দেখানো হয়।

তার আমলের এক তৃতীয়াংশ সময়ে বাংলাদেশ থেকে আনুমানিক ৫ লক্ষ কোটি টাকা পাচার হয়। আওয়ামী আশীর্বাদপুষ্ট লুটেরাদের বিদেশে ব্যবসা ও বেগম পাড়ার মতো আবাসিক বন্দোবস্ত করা হয়।

দেশে মাদক, ক্যাসিনো, চোরাকারবারি ও অবৈধ লেনদেনের প্রসার ঘটে এবং সম্রাট-বদির মতো দলীয় নেতা ও প্রদীপের মতো পুলিশ জড়িত থাকে এসব কারবারে।

স্বাস্থ্য খাতে করোনাকালেও নানা কেলেঙ্কারি বেরিয়ে আসে। জণগনকে বিপদে রেখে ক্ষমতাসীনরা চিকিৎসা গ্রহণ করেন বিদেশে।

সরকারের দুর্নীতি ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ধামাচাপা দেওয়ায় অপপ্রয়াসে,গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ, দালালদের প্রচারযন্ত্র নির্মাণ ও মিডিয়া শিল্পের বিনাস সাধন করা হয়। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের অবনতি হয় এবং আমার দেশ, দিগন্ত টিভি বন্ধসহ মিডিয়ার কণ্ঠরোধ করা হয়।

আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, মানবাধিকার কর্মী আদিলুর রহমান খান, ফটোগ্রাফার শহীদুল আলম এবং গণস্বাস্থের প্রতিষ্ঠাতা ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর জুলুম-অত্যাচার করা হয়।

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুন (২০১২), স্কুলছাত্র ত্বকি হত্যা ও ইলিয়াস আলী গুমসহ অনেক হত্যাকাণ্ডের বিচার বিঘ্নিত করা হয়।

নারায়ণগঞ্জে সাত হত্যাকাণ্ডসহ অসংখ্য মানুষকে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা; ক্রসফায়ারের বাতাবরণে হত্যা জায়েজ করার চেষ্টা অব্যাহত থাকে। সড়ক দুর্ঘটনায় হাজার হাজার মানুষ নিহত এবং ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকারী শিশুদেরকে ‘হেলমেট বাহিনী’ দিয়ে পেটানো হয়।

সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়কে ভোটের রাজনীতিতে ব্যবহার করা হয় আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও যশোরসহ বিভিন্ন এলাকায় তাদের ওপর হামলা হয় হাসিনার রাজত্বে।

গরীব মানুষের জন্য বরাদ্দ অর্থ সাহায্য লুট এবং আবাসনে দুর্নীতি ও আবাসন প্রকল্পের নতুন ঘরে ভাঙনের রেকর্ড গড়ে আওয়ামী সরকার।

যে কোনো পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় এবং ভর্তি ও নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়। উন্নয়ন কাজে রডের বদলে বাঁশ ব্যবহার হয়, রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ২০১৬ সালে এবং একাধিক স্কুলে ২০২০-এ এই দুর্নীতি প্রকাশ পায়। তার সরকার দুর্নীতিতে এতটাই চ্যাম্পিয়ন যে, রাষ্ট্রীয় পদকের স্বর্ণ চুরি হয়।

সুন্দরবনের ক্ষতি করে রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন এবং আদানির সাথে অসম আমদানি চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। বায়ু, পানি, নদী, বনসহ পরিবেশ বিপর্যয় রোধে ব্যর্থতায় দূষণে আক্রান্ত হয়ে পড়ে দেশ ও বাসযোগ্যহীন নগর। কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত করে চাঁদাবাজি।

রপ্তানি বহুমুখীকরণ বা অর্থনীতিতে নতুন খাত সৃষ্টি করতে পারেনি হাসিনা সরকার৷ বড় বড় কথা সত্ত্বেও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদেশি বিনিয়োগ তেমন আসেনি। সম্ভাবনার বুলি আওড়িয়ে সুনীল অর্থনীতির সুবিধা নিতে কিছুই করতে পারেনি।

হাসিনার দলের প্রধানতম নির্বাচনি ওয়াদা সত্ত্বেও ব্যবসা সূচক এবং ইন্টারনেট ও ডিজিটাল সেবা পৃথিবীতে দুর্বল অবস্থান বাংলাদেশের।

মূল্যহীন প্রতিশ্রুতি দেওয়া আওয়ামী লীগ মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের বিবরণী জনসমক্ষে প্রকাশ করেনি। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে হাসিনা পরিবারের সদস্যদের আড়ম্বরপূর্ণ জীবন-যাপনের উৎস কী তার ব্যাখ্যা দেয়নি কখনো।

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি করে ব্যাংক, ব্যবসা, মিডিয়া, ফ্ল্যাট, বাগানবাড়ি নির্মাণ করেন৷ মন্ত্রী-এমপির লোকেরা ও সরকারি কর্মকর্তারা জমি, নদী দখলসহ জাতীয় সম্পদ হস্তগত করেন। শাসক দলের যুব ও ছাত্র সংগঠন সারা দেশে টেন্ডার ছিনতাই, ধর্ষণ ও হত্যার মতো জঘন্য অপরাধে জড়িত পড়ে। দুর্নীতিগ্রস্ত লোক অধিক অনুগত হয় বলে ওয়াসার তাসকিম, সেনা কর্মকর্তা জিয়া ও আইজিপি বেনজীরের মতো কর্মকর্তাই হাসিনার বেশি পছন্দ। তার দলীয়করণ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যে, সালাহ উদ্দিন ফুটবল ধ্বংস আর পাপন ক্রিকেটকে অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিয়েছেন।

হাসিনা বিরাজনীতিকীকরণ প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়েছেন। 

প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য আর জাতীয় পার্টিসহ অন্য দলগুলোর নেতা ঠিক করে দেবার মতো অশোভন কাজ করেন তিনি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ বিরোধী নেতাদেরকে মিথ্যা মামলায় বিচারকদের প্রভাবিত করে সাজা দেওয়া হয়। যুদ্ধাপরাধ, ২১ আগস্টের বোমা হামলা ও ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার মামলায় দুর্বল অভিযোগ, অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়, নিরপরাধ নেতৃবৃন্দকে ফাঁসি ও জেল দেওয়া হয়।

দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে অপদস্ত করে জেলে পাঠানো ও তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক দখলের অপচেষ্টা করা হয়। প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে গোয়েন্দাদের দিয়ে অপমান করে দেশ থেকে বিতাড়ন করা হয়।

জাতীয় পর্যায়ের নেতা-নেত্রী ও সম্মানিত ব্যক্তিদের সম্পর্কে বারংবার অশোভন বক্তব্য প্রদান করেন হাসিনা। সমাজ ও রাজনীতির সুষ্ঠু নিয়ম-কানুন গুঁড়িয়ে দিয়ে সৌহার্দ্য এবং সামাজিক সম্পর্কের মূলধন (সোস্যাল ক্যাপিটাল) বিনষ্ট করেন। রাজনৈতিক বক্তৃতা বা ন্যারেটিভ শিষ্ঠাচার বিবর্জিত এমন হিংসাত্মক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয় যে সমাজে কোনো অনুসরণযোগ্য ব্যক্তিত্ব বা রোল মডেল অবশিষ্ট থাকেনি।

বিচার বিভাগ পুতুল খেলায় পরিণত হয়; ন্যায়বিচারহীন ব্যবস্থায় একজন বিচারপতি বলেন, ‘সত্য কোনো (নৈতিক) ঢাল নয়'। অসৎ উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধন ও আইনের যথেচ্ছাচার ব্যবহার করে দেশ পরিচালনার নিয়ম-নীতি ছেলে খেলায় পরিণত করা হয়।

হাসিনা পরিবার আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ভাসানী ও শামসুল হক ও স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানকে অস্বীকার এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হাইজ্যাক করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে মিথ্যাচার করে ইসলাম ও মুসলমানদেরকে সাংঘর্ষিক পর্যায়ে নেওয়া ও টার্গেট বানিয়ে ফেলা হয়। পাঠ্যবই, নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া ও সরকারি প্রচারে এত সব মিথ্যাচার করা হয় যে ভবিষ্যতে সত্য ইতিহাস জানা কঠিন হবে।

হাজারো হাসিনা-কাণ্ডের ভিড়ে কিছু কথা ভুলেও যায় মানুষ। ৫৭ বছর বয়সে অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি ১৯৯৮ সালে, আর পচাত্তরের পরও তিনি প্রধানমন্ত্রী হোক না জবরদখলকারী! একটি সংসদ রেখে আরেকটি সংসদ নির্বাচন এবং গণতন্ত্রের নীতি হিসেবে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের ব্যবস্থা ধ্বংস করে সংবিধানও লংঘন করেন তিনি।

২০০০-২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তিনি লিখে নিয়েছিলেন সরকারি গণভবন। ২০১৪ থেকে অবৈধভাবে তিনি দখল করে রাখেন বাংলাদেশ সরকারের সবকিছুই। একদলীয় বাকশালী কায়দায় তিনি এমন একটি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেন যেখানে তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর বৈধ কোনো উপায় রাখেননি, বিপ্লব, গৃহযুদ্ধ বা আন্তর্জাতিক অবরোধ ছাড়া।

খাজা মাঈন উদ্দিন, সাংবাদিক।