
কদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরছে ছবিটা। পেছনে পুলিশ, সামনেই সড়ক বিভাজকের আড়ালে আশ্রয় নিয়েছেন দুজন। কারা তাঁরা? কেন লুকিয়ে আছেন? কী হয়েছিল সেদিন? ছবিটি তুলেছিলেন প্রথম আলোর আলোকচিত্রী খালেদ সরকার। এই ছবি তুলতে গিয়ে ছররা গুলিও বিঁধেছিল তাঁর শরীরে। সেদিনের অভিজ্ঞতা শুনুন তাঁর মুখে।
দিনটা ১৯ জুলাই
সেদিন আমার সাপ্তাহিক ছুটি। কিন্তু সারা দেশ তখন উত্তাল। সকাল থেকেই খবর পাচ্ছিলাম, ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনকারীরা জড়ো হতে শুরু করেছেন। একজন ফটোসাংবাদিক হয়ে এ সময় বাসায় বসে ছুটি কাটানোর কথা ভাবতেই পারি না। পরিবারের সদস্যরা অবশ্য মানতে পারছিলেন না। ছুটির দিনে বাসা থেকে বেরোতে হবে কেন? অনেক কষ্টে তাঁদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাস্তায় নামি।
উত্তরার বিএনএস টাওয়ার পর্যন্ত পৌঁছাতে তিন জায়গায় পুলিশের চেকপোস্ট পেরোতে হলো। তবে যাওয়ার পুরো পথটাই ছিল ফাঁকা। নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছে দেখলাম, আন্দোলনকারীরা তখনো সংখ্যায় কম। স্কয়ার টাওয়ারের সামনে দেখলাম, বিআরটিসির একটি বাসে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ঝটপট কয়েকটা ক্লিক করলাম। চোখে পড়ল, পাশের বড় ভবনগুলোর সামনের কাচগুলো ভাঙা।
যেভাবে গুলি লাগল
একটু এগিয়ে আজমপুর। উল্টো দিকেই উত্তরা পূর্ব থানা। চারদিক থেকে থানার সামনে এসে জড়ো হয়েছেন আন্দোলনকারীরা। একপর্যায়ে তাঁরা থানা ঘেরাও করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। আমি তখন আজমপুর পদচারী-সেতুর ওপর থেকে ছবি তুলছি। এক সময় মনে হলো, এখান থেকে ভালো ছবি হবে না, নিচে নামতে হবে।

থানার উল্টো পাশে একটা মার্কেটের সিঁড়িতে অবস্থান নিলাম। হঠাৎই গুলি ছুড়তে শুরু করে পুলিশ। আমার তখন হিতাহিত ভাবার মতো অবস্থা নেই। একের পর ক্লিক করে যাচ্ছি। ছাত্র-জনতা যে যেদিকে পারছেন ছুটছেন। খেয়াল করলাম, সবাই সরে পড়লেও দুজন আটকা পড়েছেন (পরে জেনেছিলাম, তাঁদের একজনের নাম রায়হান মোল্লা)। আহত হয়ে সড়ক বিভাজকের আড়ালে কোনো রকম আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁরা। ওপাশে কী চলছে, দেখার উপায় তাঁদের ছিল না। পুলিশ গুলি ছুড়ছিল মূলত আমার চারপাশে থাকা আন্দোলনকারীদের দিকে। আটকে পড়া দুজনকে বাঁচাতে যে কেউ এগিয়ে যাবেন, সেই উপায়ও ছিল না।
ক্যামেরায় একের পর এক আহত দুজনের ছবি তুলতে থাকি। হঠাৎই আমার হাতে এসে লাগে চারটি ছররা গুলি। রক্ত পড়তে শুরু করে। দুই হাতে ক্যামেরা ধরে রাখতে পারছিলাম না। এক হাতে ধরেই কয়েকটা ক্লিক করলাম।
হাতে রক্ত দেখে আর্জেন্টিনার জার্সি পরা এক শিক্ষার্থী দৌড়ে এলেন। দ্বিতীয়বার না ভেবেই জামা খুলে বেঁধে দিলেন আমার হাত। বললাম, ‘আপনার গায়ে তো কিছু থাকছে না।’ ‘কোনো সমস্যা নেই। ব্যবস্থা করে নেব,’ বললেন তিনি। ‘কাছেই আমার বাসা। আপনি আগে নিজের হাত সামলান।’
হুড়োহুড়ির মধ্যে সেই তরুণের নামটাও জানা হয়নি। তাঁর জার্সি এখনো আমার কাছেই রয়ে গেছে।
আরও একটি ছবির গল্প
সেদিনই তোলা আরও একটা ছবি পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোড়ন ফেলেছে। সেটার গল্পও বলি।
সকাল গড়িয়ে তখন দুপুর। জুমার নামাজের সময় সড়ক ছেড়ে দিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা। এর মধ্যে আমিও একটু প্রাথমিক চিকিৎসা নিলাম। নামাজের পর আবার সবাই জড়ো হতে শুরু করেন। মুখোমুখি পুলিশ। বিকেলজুড়ে চলে কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট আর ছররা গুলির বৃষ্টি।
পুলিশের এত প্রতিরোধ সত্ত্বেও ছাত্র-জনতা সেদিন পিছপা হননি। বিকেলে একসময় চোখে পড়ল, লাল টি–শার্ট পরা আন্দোলনকারীদের একজন পুলিশের সঙ্গে কথা বলার জন্য হাত উঁচু করে এগিয়ে আসছেন। উল্টো দিক থেকে এগিয়ে আসেন পুলিশের দুই সদস্য। কাছাকাছি এসে কথা বলতে বলতেই আচমকা গুলি করে বসেন পুলিশের এক সদস্য।

পরে জেনেছি, লাল টি–শার্ট পরা তরুণের নাম রাতুল। সেদিন গুরুতর আহত হয়েছিলেন তিনি।
সরকার–সমর্থকেরা সেদিন লাঠিসোঁটা, দেশি অস্ত্র, এমনকি প্রাণঘাতী অস্ত্র নিয়েও আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণ করেন। তখনো হাতে জার্সি বাঁধা অবস্থায় ছবি তুলে যাচ্ছি। একজন আমাকে দেখে ফেলে আমার ওপর চড়াও হন। হাঁটুতে বেশ ব্যথা পাই। হাঁটতে পারছিলাম না। তখন ইন্টারনেট বন্ধ। বাসায় গিয়ে যে ছবি পাঠাব, সে উপায় নেই। একজন ফটোসাংবাদিকের সহায়তায় অফিসে এসে ছবি দিয়ে তারপর বাসায় ফিরি।