
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিতীয় দফার বাণিজ্য আলোচনার তৃতীয় ও শেষ দিন উভয় দেশ বেশ কয়েকটি বিষয়ে একমত হয়েছে। তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। দুই পক্ষই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আন্ত মন্ত্রণালয় আলোচনা অব্যাহত রাখার।
শুল্ক আলোচনার এখনো সুরাহা না হলেও এরই মধ্যে বিশ্বখ্যাত ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্টের কয়েকটি অর্ডার স্থগিত বা বিলম্বিত করা হয়েছে।
একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের বৃহত্তম দেশ। দেশটিতে সাড়ে আট বিলিয়ন ডলার বা ১৮ শতাংশের বেশি পোশাক রপ্তানি হয়।
বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা বলছেন, আগামী ১ আগস্ট থেকে এই নতুন শুল্ক কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে আগের প্রায় ১৬ শতাংশ ও নতুন ৩৫ শতাংশ শুল্কসহ বেশির ভাগ বাংলাদেশি পণ্যের ওপর মোট শুল্কের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৫১ শতাংশ।
ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ৮.৪ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি বাজার, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে। এ কারণে নতুন শুল্ক নিয়ে তৈরি হওয়া অনিশ্চয়তা তাঁদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া শুল্ক দেশের পোশাক খাতের জন্য একটি অশুভ বার্তা হলেও আমাদের বিশ্বাস বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে আলোচনা হয়েছে এর মধ্যে একটি ইতিবাচক ফল আসবে। যদি ৩৫ শতাংশ শুল্ক বহাল থাকে, তাহলে সত্যিই টিকে থাকা কঠিন হবে।’
ক্রেতাদের থেকে কার্যাদেশ বাতিল বা বিলম্বিত ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওয়ালমার্ট তাদের একটি সরবরাহকারীকে কার্যাদেশ বিলম্বিত করা কথা বললেও বাতিল করার কোনো ঘটনা জানা যায়নি।
বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশের রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক শিল্প বর্তমানে এক নজিরবিহীন অনিশ্চয়তার মুখোমুখি।
আড়াই বিলিয়ন ডলার বাড়তি শুল্ক দিতে হবে বাংলাদেশকে : অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (ওটেক্সা) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর বাংলাদেশ থেকে ৭.৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পোশাক আমদানি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সর্বনিম্ন শুল্ক ১৫.৫০ শতাংশ বিবেচনা করলে এই আমদানির মোট শুল্কের পরিমাণ হবে ১.১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে আরোপ করা ৩৫ শতাংশ শুল্ক যদি গত বছরের শুল্কের সঙ্গে যোগ করা হয় তবে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩.৭১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ শুল্ক আলোচনায় সমঝোতা না হলে গত বছরের চেয়ে ২.৫৭ বিলিয়ন ডলার শুল্ক অতিরিক্ত দিতে হবে বাংলাদেশকে।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই বিদেশি ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক উৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তাঁদের জন্য অন্য দেশে গিয়ে উৎপাদন করা কঠিন। এর প্রধান কারণ হলো—আমাদের অবকাঠামো, দক্ষ শ্রমিক ও তৈরি পোশাক খাত পরিচালনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। নতুন শুল্ক কমিয়ে আনতে বাংলাদেশকে ত্বড়িত উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য আনতে হবে, যাতে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। অভ্যন্তরীণ ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে, পণ্যের উদ্ভাবন করা অব্যাহত রেখে এবং নতুন বাজারে বৈচিত্র্য আনার মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে এবং তৈরি পোশাক খাতে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারে বাংলাদেশ। তৈরি পোশাকের বাজারে প্রতিনিয়ত যেসব পরিবর্তন আসছে তার সঙ্গে শুল্ক, বাণিজ্য ও বাজার প্রবৃদ্ধির গতিপথ ওতপ্রোতভাবে জড়িত।’
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ফের আলোচনা : প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়েছে, দুই দেশের প্রতিনিধিরা আবারও আলোচনায় বসবেন, সেটি ভার্চুয়ালি এবং সামনাসামনি উভয়ভাবেই হতে পারে। খুব শিগগিরই এসংক্রান্ত সময় ও তারিখ নির্ধারণ করা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এতে আরো বলা হয়, বাণিজ্য উপদেষ্টা, বাণিজ্যসচিব এবং অতিরিক্ত সচিব ১২ জুলাই দেশে ফিরেছেন। প্রয়োজনে তাঁরা আবারও যুক্তরাষ্ট্র সফর করবেন। তিন দিনের আলোচনার ভিত্তিতে বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ইতিবাচক সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে গত ৯ জুলাই এই বাণিজ্য আলোচনা শুরু হয়। আলোচনায় বাংলাদেশ পক্ষের নেতৃত্ব দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব ঢাকা থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন। এ ছাড়া ভার্চুয়ালি আরো উপস্থিত ছিলেন সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা। তিন দিনের এই আলোচনা সমন্বয় করেছে ওয়াশিংটন ডিসির বাংলাদেশ দূতাবাস।
বাড়তি শুল্কের খরচ ভাগ করে নিতে মার্কিন ক্রেতাদের চাপ : বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর মার্কিন ক্রেতারা নতুন অর্ডার নিয়ে আলোচনা প্রায় স্থগিত করে দিয়েছেন। একই সঙ্গে এরই মধ্যে যেসব পণ্যের চালান পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে, সেগুলোর ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ হলে বাড়তি খরচের একাংশ বাংলাদেশি সরবরাহকারীদের ভাগ করে নিতে বলছেন তাঁরা।
বিশেষ করে যেসব পণ্যের অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে কিন্তু এখনো পাঠানো হয়নি, সেগুলোর খরচ ভাগাভাগি নিয়ে ক্রেতারা নতুন করে আলোচনা শুরু করায় এই উদ্বেগ আরো বেড়েছে।
অনন্ত গার্মেন্টস লিমিটেডের মোট রপ্তানির ২০ শতাংশের বেশি যায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইনামুল হক খান বাবলু গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের সভা হয়েছে। তারা পাইপলাইনে থাকা অর্ডারে ট্যারিফের কারণে বাড়তি টাকার একটি অংশ বহন করার জন্য আমাদের বলছে।’ তিনি বলেন, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের জন্য পাইপলাইনে থাকা মোট ক্রয়াদেশের পরিমাণ দুই বিলিয়ন ডলারের মতো হতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের অপেক্ষায় রপ্তানিকারকরা : ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্ক ঘোষণার পর সম্ভাব্য করণীয় নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে মঙ্গলবার পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পক্ষ থেকে সময় চাওয়া হয়।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ‘আমরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করছি, কিন্তু এখনো শিডিউল পাইনি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নেগোসিয়েশনের জন্য যাতে লবিস্ট নিয়োগ দেওয়া হয়, সে প্রস্তাব আমরা সরকারকে দেব। এ ছাড়া আমাদের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি তুলে ধরে সমাধানের উপায় নিয়েও আলোচনা করতে চাই।’
ভিয়েতনামের পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক : চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ থাকলেও তারা আলোচনা করে ঐকমত্যে পৌঁছেছে, ভারতও সমঝোতায় গেছে। ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তিতে উপনীত হয়েছে। তাদের ওপর যে শুল্ক ছিল, সেটা অর্ধেক থেকেও কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। বাংলাদেশের জন্য ২০ শতাংশ বা যদি তার কাছাকাছি শুল্ক না হয় সে ক্ষেত্রে একটা প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে থাকবে না দেশ।
১ আগস্টের পর সময় বাড়বে না : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হতে যাওয়া নতুন উচ্চহারে শুল্ক আরোপের সময়সীমা আর বাড়াবেন না। তিনি আরো জানান, ওষুধ খাত নিয়েও খুব শিগগিরই ঘোষণা আসবে। তবে উৎপাদকদের তাঁদের কার্যক্রম যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তরের জন্য প্রায় এক থেকে দেড় বছর সময় দেওয়া হবে। এই সময়ের পর তাঁরা বিশাল হারে শুল্কের মুখে পড়বেন। তা প্রায় ২০০ শতাংশের মতো।
আশাবাদী সরকারের নীতিনির্ধারকরা : বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের সঙ্গে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান আলোচনা সম্পর্কে খোঁজ নেন।
ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘প্রায় সব চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্টরা আমার সঙ্গে বৈঠক করতে এসেছিলেন। তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রে ট্যারিফ নেগোসিয়েশনের বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। আমি তাঁদের বলেছি, তিন দিনব্যাপী আলোচনা চলছে এবং এখন পর্যন্ত ফল ভালো। ব্যবসায়ীদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।’