
বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮) ‘দিনের ভোট রাতে নেওয়ার সঙ্গে জড়িত’ ১২ কর্মকর্তাকে ‘পুরস্কৃত’ করেছে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এই কর্মকর্তাদের পরিকল্পিতভাবে ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে, এমন অভিযোগ তদন্ত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। তদন্ত করে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা দুদক বলেছে, ফ্ল্যাট বরাদ্দে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। পাশাপাশি জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষও বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি গঠন করে।
দুদকের তদন্ত ও গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের বোর্ড সভায় ওই সব ফ্ল্যাটের বরাদ্দ বাতিল করা হয়েছে। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়েছে। গত মঙ্গলবার এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
যাদের ফ্ল্যাট বরাদ্দ বাতিল হয়েছে তাদের একজন সাবেক সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদ। এখন তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর একজন বিচারক।
এই বিচারক ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের সময় আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত কর্মকর্তা (জেলা জজ) ছিলেন। এখানে সংযুক্ত থেকে ওই সময় তিনি কোর্ট অব সেটেলমেন্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের (জুলাই-আগস্ট ২০২৪) সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা মামলার বিচার চলছে।
ফ্ল্যাট বরাদ্দ বাতিলের সপ্তাহ তিনেক আগে গত ১৭ জুন ট্রাইব্যুনাল-২-এর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এই ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্যের একজন মো. মঞ্জুরুল বাছিদ।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর বিচারকদের ওই দিন সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা আল্লাহর ওপর নির্ভর করে পথ চলি। তার ওপর নির্ভর করে কাজ করি। কেউ বোমা মারলেও ভয় পাব না। কেউ গুলি করে মেরে ফেললে আমার সব গুনাহ নিয়ে যাবে। ফলে আমার ভয়ের কারণ নেই। আমি কবরের পাশে দাঁড়ানো, আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। ভয়ের কিছু নেই। আমরা এই তরি বয়ে নিয়ে যাব।’
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা এসব বিচারের তরি বয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করার সময় মো. মঞ্জুরুল বাছিদসহ ট্রাইব্যুনাল-২-এর অপর দুই বিচারক উপস্থিত ছিলেন।
ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী ওই সময় আরও বলেন, ‘কিছু লোক গত ১৫ বছর ক্ষমতা দখল করে রেখেছিলেন। তারা নিষ্ঠুরভাবে শাসন করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলার সাহস করেননি। মানুষ নিজেদের কথা বলতে পারেননি। সেই ফ্যাসিস্টরা এখনো ফিরে আসার চেষ্টা করছে।’
তিনি বলেন, শত শত ছাত্র-জনতা জীবন দিয়ে মানুষকে স্বাধীনভাবে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছেন। অনেকে আহত হয়েছেন। তাদের অনেকে এখনো যথাযথ চিকিৎসা পাননি। বিচারকরা চেষ্টা করছেন ছাত্র-জনতার দুর্ভোগ কমাতে।
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। তাদের নাম উল্লেখ করে বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী জানান, ভয়হীন ও পক্ষপাতহীনভাবে তারা কাজ করবেন। তাদের কাছ থেকে ন্যায়বিচার আশা করা যায়। তারা আন্তর্জাতিক নিয়ম ও প্রক্রিয়া মেনে চলবেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের বিষয়গুলোও মেনে চলবেন বলেও উল্লেখ করেন নজরুল ইসলাম চৌধুরী।
উল্লেখ্য, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমত্যাচ্যুত হওয়ার পর দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের ওই সব ফ্ল্যাট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ জমা পড়ে। রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় একটি নির্মাণাধীন ভবনে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল প্রভাবশালী এসব আমলা ও বিচারককে। এসব ফ্ল্যাট বরাদ্দ বাতিল করে মন্ত্রণালয় বলেছে, এসব ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে নীতিমালা ভেঙে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম গত বৃহস্পতিবার দৈনিক খবরের কাগজকে বলেন, ‘এই বিষয়ে আমরা প্রসিকিউশন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলব না।’