Image description
 

জুলাই-আগস্ট ঘটনায় নিজেকে আমি অপরাধী মনে করছি। আই ফিল গিলটি! আমার জ্ঞানের মধ্যে থাকা ওই সময়ের সবকিছুর বিস্তারিত ও সত্য ঘটনা স্বেচ্ছায় তুলে ধরতে চাই। ঘটনার মূল রহস্য উদ্ঘাটনে ট্রাইব্যুনালকে সহায়তা করতে চাই।

গতকাল বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কথাগুলো বলেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। পরে বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাঁকেসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।

 
 

এ মামলায় প্রধান আসামি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। দু’জনই বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন।

গতকাল অভিযোগ গঠনের শুনানির সময় কাচে ঘেরা কাঠগড়ায় চেয়ারে মামুনকে স্বাভাবিক দেখা যায়। পাঁচটি অভিযোগ পড়ে শোনানোর পর এ মামলায় আসামিদের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে জানতে চান ট্রাইব্যুনাল। বসা থেকে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে একটি কাগজ বের করে মাইক্রোফোনে অপরাধগুলোর সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততার কথা তুলে ধরেন মামুন। পরে এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের কাছে সাক্ষী হওয়ার আবেদন জানান তিনি।

অপরাধ স্বীকার করায় মামুনের নিরাপত্তার স্বার্থে কারাগারে তাঁকে আলাদা রাখার আবেদন করেন আইনজীবী জায়েদ বিন আমজাদ। ট্রাইব্যুনাল আবেদন মঞ্জুর করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। ট্রাইব্যুনাল থেকে কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে সাবেক আইজিপিকে আলাদা একক সেলে রাখা হয়েছে বলে কারা সূত্র জানিয়েছে।

চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ট্রাইব্যুনালের কাছে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়ে নিজের দোষ স্বীকার করেন। সেই অপরাধের সবকিছু তাঁর জানার কথা। সব তথ্য উদ্ঘাটনে ট্রাইব্যুনালকে সহায়তার মাধ্যমে তিনি ‘অ্যাপ্রুভার’ হতে চেয়েছেন। সে প্রার্থনা ট্রাইব্যুনাল মঞ্জুর করেছেন।

তাজুল ইসলাম বলেন, মামুন পরে সুবিধাজনক সময়ে নিজের বক্তব্য ট্রাইব্যুনালের কাছে উপস্থাপন করবেন এবং প্রকৃত ঘটনাসহ অপরাধ কাদের মাধ্যমে, কীভাবে সংঘটিত হয়েছিল, তা উদ্ঘাটনে সাহায্য করবেন। আইনের ভাষায় মামুন ‘অ্যাপ্রুভার’ হয়েছেন, বাংলায় যেটি ‘রাজসাক্ষী’। তিনি এখন কারাগারেই থাকবেন। সাক্ষী হিসেবে বক্তব্য গ্রহণের পর তাঁর বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।

আইনজীবীরা বলছেন, কোনো আসামি স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দিলে তাঁকে রাজসাক্ষী বিবেচনা করা হয়। সাবেক আইজিপি মামুন নিজে থেকে ট্রাইব্যুনালের কাছে এমন ইচ্ছা পোষণ করায় তাঁকেও এ মামলায় রাজসাক্ষী ধরা হচ্ছে।

অবশ্য ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন এবং তদন্ত-সংশিষ্টরা আগেই সমকালকে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে সাবেক আইজিপি মামুনের রাজসাক্ষী হতে ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ১৫(১) ধারায় আসামিদের সাক্ষ্য দেওয়ার বিধান রয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামির ‘রাজসাক্ষী’ হতে আইনি কোনো বাধা নেই বলে জানান তদন্ত সংস্থার প্রধান আনসারউদ্দিন খান পাঠান। সমকালকে তিনি বলেন, ‘কোনো আসামি চাইলে ট্রাইব্যুনালের অনুমতি নিয়ে প্রধান আসামির বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হতে পারবেন।’

রাজসাক্ষী হলে বিচারে আসামির সুবিধা বিষয়ে আনসারউদ্দিন বলেন, ‘কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইলে ট্রাইব্যুনাল তাঁর শাস্তি কমাতে, এমনকি ক্ষমা পর্যন্ত করতে পারেন।’

সুনামগঞ্জের শাল্লার বাসিন্দা চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ২০২২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর আইজিপি হন। আগে তিনি র‌্যাবের মহাপরিচালক ও সিআইডিপ্রধান ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের ৭ আগস্ট মামুনকে বিশেষ পরিস্থিতিতে অবসরে পাঠানো হয়। এর পর ৪ সেপ্টেম্বর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। হত্যা, হত্যাচেষ্টা, গুমসহ নানা অভিযোগে এ পর্যন্ত মামুনের বিরুদ্ধে ১৬৬টি মামলা হয়েছে।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। গত ১৬ মার্চ ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে ওই মামলায় সহযোগী আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় সাবেক আইজিপি মামুনকে। সেদিন ট্রাইব্যুনালে শুনানির পর তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনার নির্দেশনা সরাসরি বাস্তবায়নের প্রধান ছিলেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এ জন্য কৌশলগত কারণে তাঁকে সহযোগী আসামি করা হয়েছে।’

আসামি করার দু’দিন পর তদন্ত সংস্থার ধানমন্ডির সেফহোমে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। অভ্যুত্থানের সময় মাঠ পর্যায়ের পুলিশকে কারা সরাসরি গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা উঠে আসে তাঁর জবানবন্দিতে। এ সময়ই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হওয়ার ইচ্ছার কথা তদন্ত সংস্থাকে জানান মামুন।

তদন্ত সংস্থার সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মামুন মনে করেন, গণঅভুত্থানের সময় তাঁর আইজিপির দায়িত্বকে সরকারের শীর্ষ মহল নিজেদের স্বার্থ হাসিলে ব্যবহার করেছে। কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই অভ্যুত্থান, তার বিস্তারিত তথ্য-উপাত্তসহ ট্রাইব্যুনালকে জানাবেন মামুন। শেখ হাসিনার নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বারবার মামুনকে কেন তাগিদ দিয়েছেন, তাও তুলে ধরবেন। সবকিছুই চূড়ান্ত হবে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তের পর। তবে কোনো কারণে শেষ মুহূর্তে মামুন রাজসাক্ষী হতে অপারগ হলে ট্রাইব্যুনালের বিচারে আসামি হিসেবেই তিনি সাজা ভোগ করবেন বলে জানা গেছে।

বাড়তে পারে রাজসাক্ষী

সূত্র জানায়, জুলাইয়ের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আরও দু’জন আসামি রাজসাক্ষী হতে নিজেদের ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন। কারাবন্দি দু’জনের বাড়িই চট্টগ্রামে। একজন রাজনীতিক; অন্যজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।

আইনে রাজসাক্ষীর সুবিধা

রাজসাক্ষী অর্থাৎ, রাজার সাক্ষী। অপরাধ দমনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং এ কারণে অধিকাংশ অপরাধের মামলার বাদী রাষ্ট্র। প্রাচীনকালে মামলার বাদী হতেন রাজা। সেখান থেকেই এসেছে রাজসাক্ষী। রাজসাক্ষী অপরাধ সংঘটনের একজন সহায়ক ব্যক্তি ও নিজেই একজন সাক্ষী।

ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ৩৩৭ ধারায় কেবল দায়রা আদালতে বিচারযোগ্য কোনো অপরাধ বা ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় কোনো অপরাধ বা বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনের ২১৬(ক), ৩৬৯, ৪০১, ৪৩৫ বা ৪৭৭ (ক) ধারার কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে আদালত অপরাধটির তদন্ত, অনুসন্ধান বা বিচারের কোনো পর্যায়ে সেটির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত বা সে সম্পর্কে গোপন তথ্যের অধিকারী অনুমিত কোনো ব্যক্তির সাক্ষ্য সংগ্রহের উদ্দেশে তাকে (আসামি) এই শর্তে ক্ষমা করার প্রস্তাব দিতে পারেন, তার জানামতে অপরাধ সম্পর্কিত সামগ্রিক অবস্থা এবং সেটি সংঘটনের ব্যাপারে মূল অপরাধী বা সহায়তাকারী হিসেবে জড়িত প্রত্যেকটি লোক সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ও সত্য ঘটনা প্রকাশ করলে ক্ষমা পাবে। এই ক্ষমা গ্রহণ করাই হলো রাজসাক্ষী।

আগে খুলনার আলোচিত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকারের ১২টি হত্যা মামলায় তার সহযোগী আসামি নুর আলম বিচার চলাকালে রাজসাক্ষী হন। আদালতে তিনি এরশাদ শিকদারের বিরুদ্ধে সব মামলায় সাক্ষ্য দেন। নুর আলমের সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করেই খুলনার জলিল টাওয়ার মালিকের ম্যানেজার খালিদ হত্যা মামলায় আদালতের রায়ে এরশাদ শিকদারের ফাঁসি কার্যকর হয়। সংশ্লিষ্ট মামলায় নুর আলম ছাড় পেলেও অন্য মামলায় সাজা ভোগ করেন।