Image description
 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা ও তফসিল ঘোষণায় কালক্ষেপণের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে চরম অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। গত ১১ মাসে প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন মিলে অন্তত ৩০টি সভা করেছে। তবে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়নি। এতে করে নির্বাচনি কার্যক্রম কার্যত ‘বৈঠকনির্ভর আনুষ্ঠানিকতা’য় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষার্থীরা।

 

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিক ভবনের সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত গঠনতন্ত্র সংস্কার কমিটি ছয়টি, আচরণবিধি প্রণয়ন কমিটি সাতটি, নির্বাচন পরামর্শক কমিটি ৯টি এবং নির্বাচন কমিশন পাঁচটি সভা করেছে। এ ছাড়া কমিশন বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করছে, যার মধ্যে রয়েছেÑবিশ্ববিদ্যালয়ের বাস কমিটি, সাংবাদিক সমিতি এবং টিএসসিভিত্তিক সংগঠনগুলোর সঙ্গেও বৈঠক হয়েছে। বৈঠক থেকে বাদ পড়েনি পরিবেশ সংসদসহ অন্যান্য স্বতন্ত্র সংগঠনগুলোও। সপ্তাহে কখনো একটি, কখনো দুটি করে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এসব বৈঠক।

 

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এসব বৈঠক কালক্ষেপণের কৌশলমাত্র। মূলত ডাকসু নির্বাচন কমিশন কার্যক্রম বিলম্বিত করতেই এমন গড়িমসি করছে বলে অভিযোগ করেন বৈঠকে বসা শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি, প্রশাসন কেবল আনুষ্ঠানিকতা বজায় রেখেছে, কার্যকর কোনো সিদ্ধান্ত বা নির্বাচনসংক্রান্ত স্পষ্ট পরিকল্পনা না নিয়েই সময়ক্ষেপণ করছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) আহ্বায়ক আব্দুল কাদের বলেন, ‘প্রশাসন মিটিংয়ের নামে আনুষ্ঠানিকতা চালাচ্ছে। ১১ মাসে ৩০টিরও বেশি সভা হয়েছে; কিন্তু এখনো কার্যকর কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। এত মিটিং করার পরও কাঙ্ক্ষিত গঠনতন্ত্র সংস্কার হয়নি, তফসিলও ঘোষণা হয়নি।’

স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংসদের আহ্বায়ক জামালুদ্দিন মুহাম্মদ খালিদের মতে, ‘অনশন ও আন্দোলনের পর প্রশাসনের মিটিং-নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটলেও নির্বাচন কমিশন এসে একই পথে হাঁটছে।’

ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস অভিযোগ করেন, ‘ডাকসুসংক্রান্ত কিছু সভায় এমনকি অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়েও আলোচনা দেখানো হয়েছে। সিদ্ধান্তহীনতাই যেন প্রশাসনের মূল সিদ্ধান্ত।’

তফসিল না দেওয়ার পাশাপাশি ভোটার তালিকা নিয়েও বির্তক দানা বাঁধছে। ২০১৮-১৯ সেশনের যেসব শিক্ষার্থীর ফলাফল ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, তাদের ভোটাধিকার বাতিল করাকে ‘প্রশাসনের ব্যর্থতা ঢাকার কৌশল’ হিসেবে দেখছেন অনেকে। কারণ দীর্ঘসূত্রতার শুরুর সময়ে তারা ছাত্র অবস্থায়ই ছিলেন।

ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক সাইফ মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, ‘প্রশাসন নির্বাচন না দিয়ে সংস্কার ছাড়া নির্বাচনের বাহানা খুঁজছে। এতে অংশীজনদের মধ্যে প্রশ্ন উঠছে, প্রশাসনের আদৌ সদিচ্ছা আছে কি না।’

দীর্ঘদিন ধরে চলমান বৈঠকের এই নাটকীয়তাকে ‘প্রহসন’ আখ্যা দিয়ে নতুন করে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছে একাধিক ছাত্রসংগঠন। ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, ‘আন্দোলন না করলে নির্বাচন কমিশন হয় না, তফসিল হয় না। প্রশাসনকে আবারও মাঠে গিয়ে চাপ দিতে হবে।’

বাংলাদেশ ছাত্রফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আরমানুল হক বলেন, ‘আমরা এই প্রশাসনের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে প্রতিটি মিটিংয়ে অংশ নিয়েছি। শুরু থেকেই আমরা ক্যাম্পাসের পুনর্গঠন নিয়ে কথা বলে আসছি। ডাকসুর সংস্কার প্রস্তাবনা যখন চাওয়া হলো, আমরাও একটা গণতান্ত্রিক ডাকসু গঠনতন্ত্রের সংস্কার প্রস্তাবনা জমা দিলাম। কিন্তু প্রায় সব প্রস্তাব উপেক্ষিত।’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রশাসন যদি আমাদের প্রস্তাবনা উপেক্ষাই করবেন, তাহলে কেন এত মিটিং করল, কেনই-বা এত পরিশ্রম করে সংস্কার প্রস্তাবনা তৈরি করাল, তা আসলেই আমাদের অবাক লাগছে।’

সামগ্রিকভাবে ছাত্রনেতারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করে একটি প্রহসনের নির্বাচনের দিকে ধাবিত করছে। তাদের মতে, প্রশাসন প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে একটি অনুগত ডাকসু গঠনের কৌশল হিসেবে এই ‘মিটিং কূটনীতি’ ব্যবহার করছে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী প্রশাসনের বিএনপিকেন্দ্রিক ঝোঁক নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেক নেতা।

বাগছাস আহ্বায়ক আব্দুল কাদের বলেন, ‘তারা বুঝতেই চায় না, ৪৩ হাজার শিক্ষার্থীই তাদের শক্তির উৎস। তাদের কেউ কেউ সচেতন হলেও ‘গাটস’ নাই, আর বাকিরা নিজের আখের গোছাতে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ বিকিয়ে দিচ্ছে। বিএনপির দলীয় এজেন্ডার দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে।’

এদিকে একাধিক ছাত্রসংগঠন জুলাইয়ের মধ্যে তফসিল ঘোষণা না হলে রাজপথে নামার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের প্রশ্নÑ‘এত মিটিংয়ের পর ফলাফল কি’, প্রশাসনের দিক থেকে এখনো এর স্পষ্ট কোনো জবাব মেলেনি।

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এসএম ফরহাদ বলেন, ‘এই প্রশাসন দায়িত্ব গ্রহণের শুরু থেকে আমরা তাদের ‘বৈঠক কূটনীতি’ দেখে আসছি। এগুলো নিছক নির্বাচন পিছিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা মাত্র। তাদের এমন কার্যক্রম শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে চাই, জুলাইয়ের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা করা না হলে, আমরা কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দেব।’

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বৈঠকের ধারাবাহিকতায় গতকাল বৃহস্পতিবার ডাকসু নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সদস্যদের মতবিনিময় সভা হয়। সভায় তফসিল ঘোষণার সম্ভাব্য সময় সম্পর্কে জানতে সাংবাদিকদের প্রশ্নে মুখ খোলেনি নির্বাচন কমিশন।

ডাকসু নির্বাচন কমিশনের চিফ রিটার্নিং অফিসার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন আমার দেশকে বলেন, ‘আমরা সম্ভাব্য একটা সময় বলে দিলেই তো হবে না। তফসিল ঘোষণার আগে সর্বস্তরের শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, প্রশাসনিক ব্যক্তিত্ব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বসে আমরা তাদের মতামতগুলো শুনতে চাই। আমরা প্রতিটি বিভাগের ক্লাস রিপ্রেজেনটেটিভদের (সিআর) সঙ্গেও বসব, তাদের থেকেও মতামত নেব। তারপর সেগুলো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে বসব। এসব কাজ চূড়ান্ত করার পর আমরা নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।’

নির্বাচন কমিশনের আরেক রিটার্নিং অফিসার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. গোলাম রব্বানী বলেন, ‘তফসিল ঘোষণার বিষয়টি আমাদের মাথায় আছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে ভাবছি। কিন্তু এর আগে আমরা আমাদের ধারাবাহিক বৈঠক কার্যক্রম সম্পন্ন করতে চাই। যেন কেউ বলতে না পারে, আমাদের মতামত নেওয়া হয়নি, আমাদের শোনা হয়নি।’