
নির্বাচিত সরকারের অভাবে অনেক কিছু থমকে গেছে। যেসব সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে নির্বাচিত সরকার এলে তা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসবে। সবকিছু বিশ্লেষণ করে বলা যায় উত্তরে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ভোট পাগল মানুষ ভোটের অপেক্ষায়।
উত্তরাঞ্চল যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধ বিশ্বাসীদের দুর্জয় ঘাঁটি। ১৯৪৭ দেশভাগের সময় থেকে এ অঞ্চলের মানুষের রয়েছে এন্টি ইন্ডিয়ান সেন্টিমেন্ট। কারণ দেশভাগের সময় যে ক্ষত নিয়ে ওপার থেকে এসেছে তা বংশ পরম্পরা ধারন করে আসছে।
১৯৭৩ সালে আওয়ামী শাসনামলে রাজশাহীতে একটি আসনে জয়লাভ করেছিল জাসদ নেতা মুক্তিযোদ্ধা ময়েন উদ্দিন মানিক। ১৯৭৫’র পট পরিবর্তনের পর এ অঞ্চলের দু’একটা বাপ দাদার আসন হিসেবে (পাবনার) পেয়েছে আওয়ামী লীগ। বাকী সব আসন গেছে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দল (বিএনপির) অনুকূলে। যাকে দেয়া হয়েছে ধানের শীষ তাকে নির্বাচনে বিজয়ী করা হয়েছে। জিয়াউর রহমান শহীদ হবার পর দলের হাল ধরেন তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। আপোষহীন ভূমিকা রেখে দলকে এগিয়ে নিয়েছেন। মানুষ তার নেতৃত্বের উপর আস্থা রেখে বিএনপি প্রার্থীদের জয়ী করেছেন। যাকে মনোনয়ন দিয়েছেন তিনি জয় নিয়ে ফিরেছেন। মানুষ চেনেন জিয়া, বেগম খালেদা জিয়া, আর এ প্রজন্মের তারেক জিয়াকে। সবচেয়ে বেশি চিনেন ধানের শীষকে। এক আসনের মানুষ অন্য আসনে গিয়ে ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচিত হবার উদাহরণ অনেক রয়েছে। রাজশাহী চারঘাট বাঘা আসনের ডা. আলাউদ্দিন বিএনপির কাছে বার বার পরাজিত হবার পর শেষ বয়সে ইজ্জত রক্ষার জন্য বিএনপিতে যোগ দিয়ে ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচিত হন। পাবনার আওয়ামী লীগ নেতা বকুল পরাজিত হবার পর ধানের শীষ নিয়ে এমপি হয়েছেন।
এরশাদের পতনের পর ১৯৯০ সালে বিএনপির তরুণ নেতা মিজানুর রহমান মিনু রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচনে বিএনপি আওয়ামী লীগ শাসনামনে বার বার বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। এমপি হয়ে টানা সতের বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। তারপর মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটনকে পরাজিত করে। বিএনপি আওয়ামী শাসনামলে জামায়াতে ইসলামী রাজশাহী অঞ্চলে পাঁচ, সাতটি আসন পেয়েছে এসব দলের সাথে জোট করার সুবাদে। পরের ইতিহাস সবার জানা।
এ অঞ্চলে বার বার পারজয়ের গ্লানি মুছতে ২০০৮ সালের পর আওয়ামী সরকার পনের বছর ধরে হামলে পড়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূলবোধে বিশ্বাসী শক্তিকে নিশ্বেষ করে পরাজয়ের বদলা নিতে। পনের বছর ধরে চালিয়েছে নির্যাতনের স্টিম রোলার। এতেও শেষ করতে পারেনি। ফিনিক্স পাখির মত ফের জেগে উঠেছে বিএনপি। পনের বছর ধরে ভোট দেবার যন্ত্রনা বুকে রয়েছে সাধারণ মানুষের। তারা ভোটকে উৎসবের দিন মনে করে। নিজের ভোট নিজে দিতে চায়। সে অধিকার হরণ হয়ে গিয়েছিল দিনের ভোট রাতে আর মানুষকে ভোট কেন্দ্রে আসতে বাঁধা দেয়ার মধ্যদিয়ে। তারা জানত মানুষ কোনো ভাবে ভোটকেন্দ্রে গেলে তাদের বিপক্ষে ভোট দেবে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পলায়নের প্রায় এক বছর হলেও পনের বছরে বির্পযস্ত বিএনপি সর্বত্র এখনো গুছিয়ে উঠতে পারেনি। এর মধ্যে হাইব্রীড আর সুবিধাবাদীদের কাছে কোণঠাসা ত্যাগী নেতাকর্মীরা বিব্রত অবস্থায়।
বিএনপি বড় দল এখানে ভালোমন্দ সবাই আশ্রয় নিতে চায়। এদের কারো কারো মন্দ কাজে বিব্রত বিএনপির পুরনো নেতাকর্মীরা। ইতোমধ্যেই হাইকমান্ড শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছে। বিএনপি বড় দল এখানে বিভিন্ন পেশার মানুষ রয়েছে। নির্বাচন এলে অনেকে প্রার্থী হবার জন্য কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যন্ত ছুটে বেড়ায়। এবারো তার ব্যতিক্রম নয়। বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে বিএনপির ৩১ দফা তুলে ধরছে। নির্বাচনের মনোনয়ন পাওয়ার আশায় দৌঁড়ঝাপ করছে বহু রাজনীতিক নেতা, আমলা, ব্রিগেডিয়ার ব্যারিস্টার এমনকি প্রবাসীরা এসে তাদের নিজ এলাকায় ছুটছেন। এত আগ্রহের কারন এবার বিএনপি নিশ্চিত সরকার গঠন করবে। জরিপও তাই বলে। এ অঞ্চলে বিএনপি হলো আম জনতার দল। নেতাকর্মীর চেয়ে সমর্থকের সংখ্যা অনেক বেশি। এখন আওয়ামী লীগ দৃশ্যপটে নেই। সেখানে দ্বিতীয় দল জামায়াতে ইসলামী। এরা ক্যাডার নির্ভর দল। এদের কর্মীরা সুসংগঠিত।
আগস্টের পর পরিকল্পিত ভাবে তারা প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়সহ বড় বড় পদে তাদের লোক বসিয়ে দিয়েছে। বৃহত্তর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রোভিসিসহ বিভিন্ন পদে তাদের লোকজন, রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপালসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ নিজেদের পছন্দের লোক বসিয়েছে। শুধু রাজশাহী নয় এ অঞ্চলের সব স্থানে এমনটি হয়েছে। কোথাও এনিয়ে স্থানীয়ভাবে গ্রুপিং হবার কারণে জামায়াতও সুযোগ পুরো কাজে লাগিয়েছে। জামায়াত এ অঞ্চলের সম্ভাব্য এমপি প্রার্থীদের তালিকা করে সবুজ সিগন্যাল দিয়ে মাঠে নামিয়েছে। তারা তৎপর। এমনকি রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র কাউন্সিলর প্রার্থী মনোনয়ন শেষ করে মাঠ পর্যায়ে নামিয়েছে। সবকিছু হচ্ছে অত্যন্ত গোপন কৌশলে। তারা স্থানীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। এখন তারা অন্তবর্তী সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করছে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন ও আনুপাতিক নির্বাচনের জন্য।
ছাত্রদের দল এনসিপি জুলাই পদযাত্রা শেষ করেছে উত্তরাঞ্চল দিয়ে। জুলাই বিপ্লব পথ সভায় এনসিপি তাদের বক্তব্য সংসদে নিয়ে যাওয়ার জন্য ছাত্র জনতার প্রতি আহবান জানিয়েছে। বিজ্ঞজনরা এটিকে নির্বাচনী প্রচারণা হিসেবে দেখছে। সব মিলিয়ে বলা যায় উত্তরের নির্বাচনী হাওয়া বইছে।
রাজশাহী বারের সাতবারের নির্বাচিত সেক্রেটারি অ্যাড. জমসেদ আলী বলেন, জনগণ প্রচলিত পদ্ধতিতে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। ভোট ডাকাতি ও সন্ত্রাসমুক্ত ফ্রি ফেয়ার ইলেকশন সবার কাম্য।
পিআর নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. পারভেজ আজাহারুল হক জানান, পিআর পদ্ধতি ভালো বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় আছে। এটা নির্ভর করে দেশের রাজনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উপর। আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর পরিপক্কতার ভিত্তি এখনো গড়ে ওঠেনি। একটা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত পৌছাতে না পারলে এ পদ্ধতি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
এছাড়া ছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে পনের বছরের ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারকে বিতারিত করা হয়েছে। তারা সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে। এ অবস্থায় আমাদের নতুন করে যাত্রা শুরু হয়েছে। বিএনপি দেশের বড় দল। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন স্বৈরাচার হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে যেসব দল মাঠে ছিল ও যুগপৎ আন্দোলনে ছিল এসব দলের নেতারা নির্বাচনে জয়ী হন বা না হন বিএনপি ভবিষ্যতে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে তাদের সবাইকে নিয়ে ঐক্যমতের ভিত্তিতে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। যাতে সেই সরকারে সবার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়। বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে।
জামায়াতসহ ছোট দলগুলো স্থানীয় নেতাদের অভিমত দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্বাচনে কালো টাকার প্রভাব, ভোট ডাকাতি, সন্ত্রাসমুক্ত নির্বাচনের স্বার্থেই পিআর সিস্টেম প্রয়োজন।
সাধারণ মানুষের সাথে আলাপ করলে তারা বলেন, ভাগাভাগি পরে। আমরা চাই ভোটের মত ভোট হোক। নিকট অতীতের মত ভোটের প্রয়োজন নেই।