
অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা আবারও পর্যটন খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় থাকা পাকিস্তানও বিদেশি পর্যটক টানতে উঠেপড়ে লেগেছে। পর্যটন স্পট কাশ্মীরে জঙ্গি হামলা এবং পাকিস্তানের সঙ্গে অস্থিরতা কাটিয়ে নতুন করে পর্যটক টানতে ব্যস্ত ভারত। নেপালও শুধু হিমালয় দিয়েই প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক টানছে। দক্ষিণ এশিয়ার এই প্রতিবেশি দেশগুলো বরাবরই বিদেশি পর্যটক টানতে ব্যতিব্যস্ত থাকে। অথচ বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত ও সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও প্রাচীন পুরাকীর্তির স্থাপনা, পাহাড়-টিলা এবং হাওড়-বাঁওড় থাকার পরও বহির্বিশ্বে পর্যটন খাতে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় সবার নিচে।
পর্যটন খাত সংশ্লিষ্টরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পর্যটক আকর্ষণে প্রতিবেশি দেশ ভারত, নেপাল ও ভুটানের চেয়ে এখনও অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। ভারতে আসলে বিদেশি পর্যটকদের কেউ কেউ বাংলাদেশে দুই-একদিনের জন্য ঘুরে যান। তবে শুধু বাংলাদেশ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে পর্যটক আসছেন কম। দেশের ট্যুর অপারেটর কোম্পানিগুলোর মতে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ভিসা জটিলতা, খাবারের সমস্যা, সীমিত বিনোদন ব্যবস্থা, সামাজিক বিধিনিষেধ, অপ্রতুল যানবাহন ব্যবস্থাসহ নানান কারণে বিদেশি পর্যটকরা বাংলাদেশ ভ্রমণে অনাগ্রহী। তারা বিদেশি পর্যটক টানতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের আদলে বিশেষ পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার আহ্বান জানান। কোস্টাল ট্যুরিজম, নাইট-লাইফ ট্যুরিজম, ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়নসহ পর্যটন বহুমুখীকরণ, পর্যটনবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতকরণসহ পর্যটকদের নিরাপত্তা জোরদারে গুরুত্ব দেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিদেশিদের বাংলাদেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য আমরা প্রস্তাব দিয়েছি। যেসব দেশের নাগরিকরা বাংলাদেশে অনএরাইভাল ভিসা পান, তাদের জন্য যেন ই-ভিসা পদ্ধতি চালু করা হয়। এ ছাড়া আরও দুটি ভিসার কথা বলেছি। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ইউকে, ইউএসএ, কানাডা এবং সেনজেন ভিসা যাদের আছে, তারা যেন বিনা ভিসায় বাংলাদেশে ঢুকতে পারে- এ প্রস্তাবও দিয়েছি।
থার্ড টার্মিনাল হলে যে যাত্রীরা বাংলাদেশে ট্রানজিট করবেন- যেমন যে যাত্রী ফিলিপাইন থেকে আমেরিকা যাবেন তার ট্রানজিট যদি বাংলাদেশে হয়, তিনি যেন তার বোর্ডিং পাস দিয়ে বাংলাদেশে দুই-একদিন থাকতে পারেন, এমন প্রস্তাবও দিয়েছি। ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম ডেভলপমেন্ট ইনডেক্সে বাংলাদেশ বিশ্বের ১১৯টি দেশের মধ্যে ১০৯তম স্থানে ছিল। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম স্টাডি ২০২৪-এর প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়া প্যাসিফিকের ১৯টি এবং দক্ষিণ এশিয়ার ৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নিচে। এই সূচকে ৭ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ৩ দশমিক ১৯। যা এই পাঁচটি দেশের মধ্যে কম। এই সূচকে সবচেয়ে বেশি ৪ দশমিক ২৫ স্কোর নিয়ে ভারতের অবস্থান ৩৯তম। শ্রীলঙ্কা ৩ দশমিক ৬৯ নম্বর নিয়ে ৭৬তম। পাকিস্তান ৩ দশমিক ৪১ স্কোর নিয়ে ১০১ এবং নেপাল ৩ দশমিক ৩৪ স্কোর নিয়ে ১০৫তম স্থানে ছিল।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্যে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ৬ দশমিক ৫ লাখ বিদেশি পাসপোর্টধারী আসেন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৯ লাখই ছিল ভারতীয় নাগরিক। অবশিষ্ট ইউকে, ইউএস, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ইতালি থেকে বিদেশিরা বাংলাদেশে আসেন। কিন্তু পর্যটন খাত সংশ্লিষ্টদের হিসাব বলছে, ট্যুরিজম বোর্ডের এই সংখ্যার তুলনায় দেশে ঘুরতে আসা বিদেশি পর্যটক বা পাসপোর্টধারীর সংখ্যা আরও কম। এটি ২৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার হতে পারে। এই বিদেশি পার্সপোর্টধারীদের অনেকেই অন্য দেশের পাসপোর্টধারী প্রবাসী বাংলাদেশি। কেউ আবার ব্যবসায়িক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাজ, প্রদর্শনীসহ বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে বাংলাদেশে আসেন। ২০২৩ সালে ভারতে ৯ দশমিক ২৪ মিলিয়ন, শ্রীলঙ্কায় ১৪ লাখ ৮৭ হাজার, নেপালে ১০ লাখ ১৪ হাজার এবং পাকিস্তানে ৯ লাখ ৭৫ হাজার বিদেশি পর্যটক ঘুরতে আসেন।
ট্যুর অপারেটন এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) প্রেসিডেন্ট মো. রাফিউজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং ভ্রমণ ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বিদেশি পর্যটকরা বাংলাদেশ ভ্রমণে অনাগ্রহী। অনেক পশ্চিমা দেশ ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় সেসব দেশের পর্যটকরা বাংলাদেশে আসছেন না। এসব দেশের নাগরিকরা আমাদের দেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ইন্স্যুরেন্সভুক্ত থাকেন না। এটিও বিদেশি পর্যটক কম আসার পেছনে অন্যতম একটি কারণ। আমরা চাচ্ছি সরকার এসব দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভ্রমণনিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করবে। যেসব দেশের পর্যটক আমরা গ্রহণ করি, সেসব দেশে বাংলাদেশকে ব্যাপকভাবে ব্র্যান্ডিং করতে হবে। এসব দেশে বাংলাদেশের কনস্যুলেটে একজন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিতে হবে, যিনি শুধু বাংলাদেশের পর্যটন নিয়ে দেশীয় ট্যুর অপারেটর ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কাজ করবেন।