Image description
কোমর সমান পানিতে রাস্তায় শিক্ষার্থীরা

বন্যার দেশে প্রস্তুতি থাকে, মানুষ জানে কখন বৃষ্টি হবে, কখন নদীর পানি বাড়বে, করণীয় কী। গত কয়েক দিন বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপ এবং মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে হওয়া বৃষ্টিতে ফেনী, কুমিল্লাসহ কয়েকটি জেলায় বন্যা শুরু হয়েছে। বেশির ভাগ নদনদীর পানি বেড়ে প্লাবিত হয়েছে উপকূলীয় কয়েকটি জেলার নিচু এলাকা। পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতিও নিয়েছে ত্রাণ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন—এটাকে বন্যা বলা যাবে কিনা। তারা বলছেন, আসলে গত বছরের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ ঠিকমতো মেরামত না করার খেসারত দিতে হচ্ছে। জুলাই মাসে যে পরিমাণ স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা, তা শুরুর আগেই বাঁধ ভেঙে যাওয়া, পানি ঢুকে যাওয়া নিয়ে, এই শঙ্কার কথা ভাবছেন তারা।

হালিশহর থানার আনন্দপুর এলাকা

হালিশহর থানার আনন্দপুর এলাকায় জলাবদ্ধতা

পানি উঠছে, বাঁধ ভেঙেছে যেসব জায়গায়

ফেনীতে ভারী বৃষ্টিপাত ও ভারতের উজানের পানিতে পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। দুই উপজেলার ২০টি স্থানে বাঁধ ভাঙনে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন হাজারো মানুষ। পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, মুহুরী নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পরশুরাম উপজেলার জঙ্গলঘোনায় দুটি, অলকায় তিনটি, শালধর এলাকায় একটি, ফুলগাজী উপজেলার উত্তর শ্রীপুর এলাকায় একটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। সিলোনিয়া নদীর পরশুরামের গদানগর এলাকায় একটি ও ফুলগাজীর দেড়পড়া এলাকার দুটি স্থানে বাঁধ ভেঙেছে। এছাড়া কহুয়া নদীর পরশুরাম উপজেলার সাতকুচিয়ায় দুটি, বেড়াবাড়িয়ায় একটি ও ফুলগাজী উপজেলার দৌলতপুর এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের একটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। মঙ্গলবার (৮ জুলাই) বিকাল থেকে এসব স্থানে ভাঙন দেখা দেয়। এতে তীব্র স্রোতে পানি প্রবেশ করে।

মহিপাল

মহিপাল এলাকায় বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে

টানা ভারী বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বাড়ছে কুমিল্লার গোমতী নদীর পানি। ফলে জেলার কয়েকটি উপজেলায় বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কুমিল্লা অঞ্চলের পাশাপাশি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যেও ব্যাপক বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ওই রাজ্যের পানি গোমতী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুমিল্লা অংশের দিকে নামছে। এদিকে নোয়াখালীতে অতিবৃষ্টির ফলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা ও সম্ভাব্য বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাস বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বুধবার (৯ জুলাই) দুপুরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ইসরাত নাসিমা হাবীব বিষয়টি নিশ্চিত করেন। সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদ বলেন, ‘জলাবদ্ধতা ও বন্যা মোকাবিলায় জেলা প্রশাসনের প্রস্তুতি চলছে। পর্যাপ্ত স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছে। বিশুদ্ধ পানির জন্য মোবাইল প্ল্যান্ট ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট মজুত রাখা হয়েছে। সাপে কাটা ও ডায়রিয়াসহ জরুরি চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে বিদ্যালয় প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ত্রাণ তৎপরতা সমন্বয়ে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।’

ভারী বর্ষণ ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা ঢলে জেলার পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে

ভারী বর্ষণ ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা ঢলে জেলার পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে

শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার পদ্মা সেতু প্রকল্প রক্ষা বাঁধে ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে বসতঘর, দোকানপাটসহ ২৬টি স্থাপনা। ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটছে অন্তত ৬০০টি পরিবারের। ইতোমধ্যে নদীর পার থেকে বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন স্থানীয়রা। এদিকে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলায় টানা বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এতে উপজেলার কবাখালি ও মেরুং ইউনিয়নের শতাধিক বাড়িঘর ডুবে গেছে। হঠাৎ পানি বাড়তে থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মানুষজন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠতে বাধ্য হয়েছেন।

কেন বারবার এ পরিস্থিতি

বাড়িঘর ডুবে যাওয়ায় মানুষ অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছেন

বাড়িঘর ডুবে যাওয়ায় মানুষ অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছেন

২০২৪ সালেও বন্যার কবলে পড়েছিলেন ফেনীর বাসিন্দারা। এবার দ্রুত পানি বাড়তে দেখে তারা শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তারা মনে করেন, বেড়িবাঁধ দেওয়া ও নদী খনন না করলে প্রতিবছর তাদের এভাবে ভুগতে হবে। পরশুরামের চিথলিয়া এলাকার গৃহবধূ জাকিয়া আক্তার জানান, রাত ৮টার দিকে পানি ঘরে ঢুকে পড়ে। কোনোরকমে কিছু জিনিস নিয়ে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিয়েছি। মির্জানগরের রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পাউবোর গাফিলতির কারণেই বল্লামুখা বাঁধের প্রবেশমুখ বন্ধ করা হয়নি। প্রতি বছর কিছু লোকের দায়িত্বহীনতার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ।’

বাঁধ ভেঙে পানি ঢোকার দৃশ্য

বাঁধ ভেঙে পানি ঢোকার দৃশ্য

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা বলছেন—এটা বন্যা না, গাফিলতির খেসারত। এলাকায় যান, সাধারণ মানুষই আপনাকে সেটা বলতে পারবে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জুলাইয়ে সাধারণত যে বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা, সেটা এখনও শুরুই হয়নি, বা কেবল শুরু হচ্ছে, কিন্তু সেটাকে স্মরণকালের বেশি বলা হচ্ছে। আসলে যেটা ঘটেছে, গতবার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বাঁধ মেরামত করা হয়নি ঠিকমতো। তার খেসারত দিতে হচ্ছে।’

বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে ঢুকছে পানি

বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে ঢুকছে পানি

আদৌ স্মরণকালের বেশি বৃষ্টিপাতে বন্যা হয়েছে কিনা, সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না আবহাওয়া অফিসও। আবহাওয়াবিদ মো. শাহীনুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অতি বৃষ্টিকে এখনই এভাবে বন্যা বলা যাবে না। গত বছরও তো ওই এলাকায় বন্যা হয়েছে। গত ৩০ বছরের হিসাবের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হয়। জুন-জুলাইতে বৃষ্টি বাড়ে, আগস্টে সেটা আরও বাড়ে। ফলে মাত্র এ মাসের ৯ দিনের হিসাব দিয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না।

নোয়াখালীতে পানিতে তলিয়ে যাওয়া সড়ক

নোয়াখালীতে পানিতে তলিয়ে যাওয়া সড়ক

ফেনীর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. মাহবুব আলম বলেন, ‘আশ্রয়কেন্দ্র অনেক থাকলেও এখন পর্যন্ত ৩০টি কেন্দ্রে ৫২৫টি পরিবার ও গবাদি পশু রয়েছে। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত খাবার মজুত আছে। উপজেলা থেকে চাইলেই আমরা দিয়ে দিচ্ছি। এখন পর্যন্ত চাল ও নগদ টাকা পাঠানো হয়েছে। অনেক মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে না এসে আশপাশের পাকা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।’

পানি বেড়ে যাওয়ায় ফেনীর ফুলগাজী বাজার প্লাবিত

পানি বেড়ে যাওয়ায় ফেনীর ফুলগাজী বাজার প্লাবিত

মনিটরিংয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের পরিচালক (ত্রাণ) আব্দুর রশিদ বলেন, ‘আমাদের যে কাঠামো আছে সেটাই মরিটরিং ব্যবস্থা। জেলা-উপজেলায় যথেষ্ট ত্রাণ দেওয়া আছে, শেষ হলে তারা চেয়ে পাঠালেই আমরা পাঠিয়ে দেবো। এখন পর্যন্ত উপজেলাভিত্তিক ঢেউ টিন, শুকনো খাবার, জিআর চাল, ক্যাশ পাঠানো হয়েছে। প্রতি উপজেলার জনসংখ্যা, আয়তন, দারিদ্র্য দেখে সেগুলো বিতরণ করা হয়।’