
ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে দেশ পালানো স্বৈরাচার শেখ হাসিনা নিজেই নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করার অনুমতি দেন। আন্দোলনকারীদের যেখানেই পাওয়া যাবে, সেখানেই গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। শেখ হাসিনার ফোনালাপের একটি অডিও রেকর্ডিং যাচাই করে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। বিবিসির অনুসন্ধানী শাখা ‘বিবিসি আই’ ও বিবিসি বাংলা ই অনুসন্ধান করে বলে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয় আন্দোলনকারীদের দমন করতে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত পুলিশ বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের নির্মম কাহিনি। হাসিনা ভারতে পলায়নের পরও পুলিশ নির্বিচারে গুলি করে আন্দোলনকারীদের ওপর। ৫ আগস্ট বিকালের দিকে শুধু যাত্রাবাড়ীতেই পুলিশ নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে অন্তত ৫২ জন সাধারণ মানুষকে। এ হত্যাকাণ্ড চলে ৩০ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে। শুধু গুলি করে হত্যা করেই থামেনি অতি উৎসাহী পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। সেদিন গুলিতে যারা আহত হন, তাদের লাথি মারতে দেখা গেছে পুলিশকে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তখনকার খবর, নিহতদের পরিবারের সাক্ষাৎকার, হাসপাতালের নথি এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন পোস্টের সত্যতা যাচাই করার পর বিবিসি এ তথ্য জানিয়েছে।
পুলিশির গুলিতে এত মানুষ হত্যার ঘটনাকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ পুলিশি সহিংসতাগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করেছে গণমাধ্যমটি। আন্দোলন দমাতে পুলিশ সদস্যরা অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেছেন। তাদের আচরণও ছিল অপেশাদার। গত বছর সরকারবিরোধী বিক্ষোভের শেষ দিনে ভয়াবহ ঘটনাটি কীভাবে ঘটেছিল, তা অনুসন্ধানে শত শত ভিডিও, ছবি ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য গ্রহণ এবং সেগুলো বিশ্লেষণের পাশাপাশি সরেজমিন যাত্রাবাড়ীর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিবিসি।
বিবিসি বলছে, জাতিসংঘের প্রতিবেদন ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে নানান খবর প্রকাশিত হলেও নির্বিচারে হত্যার ঘটনাটি কীভাবে শুরু ও শেষ হয়েছিল এবং তাতে কত মানুষ হতাহত হয়েছিল, সে সম্পর্কে এমন কিছু তথ্য ও বিবরণ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, যা আগে সেভাবে সামনে আসেনি।
আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচার গুলি ও হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বক্তব্য জানতে বাংলাদেশ পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বাহিনীর একজন মুখপাত্র ঘটনা স্বীকার করে বিবিসিকে বলেন, জুলাই গণ অভ্যুত্থানের সময় এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে, যেখানে তৎকালীন পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্য অতিরিক্ত বল প্রয়োগে লিপ্ত হয়েছিলেন এবং আন্দোলনকারীদের নিয়ন্ত্রণে অপেশাদার আচরণ করেছিলেন।
যাত্রাবাড়ীতে হত্যাকাণ্ডের একটি বিবরণ দিয়ে বিবিসি বলেছে, ৫ আগস্ট বিকালে যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিবর্ষণ শুরুর একটি ভিডিও সংগ্রহ করা হয়। ভিডিওটি মিরাজ হোসেন নামে যে আন্দোলনকারীর মোবাইল ফোন সংগ্রহ করা হয়, তিনিও সেদিন পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান। মর্মান্তিকভাবে মোবাইল ক্যামেরায় ওই ভিডিওতে তার জীবনের শেষ মুহূর্তও ধরা পড়ে।
মিরাজের মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যরা তার মোবাইলটি খুঁজে পান এবং ভিডিওটি বিবিসিকে দেন। ভিডিও বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সেদিন নির্বিচারে গুলিবর্ষণের ঘটনাটি শুরু হয়েছিল দুপুর ২টা ৪৩ মিনিটে। ভিডিওতে যাত্রাবাড়ী থানার মূল ফটকে বিক্ষোভকারীদের সামনে সেনাবাহিনীর একটি দলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এরপর হঠাৎ করেই তারা ওই এলাকা থেকে সরে যান। এ ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই যাত্রাবাড়ী থানার ভিতরের পুলিশ সদস্যরা ফটকের সামনে অবস্থানরত বিক্ষোভকারী জনতার ওপর আকস্মিকভাবে গুলিবর্ষণ শুরু করেন।
বিকাল ৩টা ১৭ মিনিটেও যাত্রাবাড়ী থানার সামনের মহাসড়কে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাচ্ছিল পুলিশ। ড্রোন ভিডিওতে মহাসড়কের ওপর হতাহতদের একাধিক মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। ভ্যান-রিকশা এবং বাইকে করে গুলিতে আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন আন্দোলনকারীরা। হাসপাতালে আরও অনেক মানুষকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। ওই সময়ের আরেকটি ভিডিওতে আহতদের শরীরে লাথি মারতেও দেখা যায় পুলিশকে। আন্দোলনকারীদের ওপর আধা ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে নির্বিচারে গুলি আর হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ একটি অংশ থানায় আগুন দেয়। এ ঘটনায় পুলিশের কমপক্ষে ছয়জন সদস্য নিহত হন। গত বছরের ৪ আগস্টেও যাত্রাবাড়ী থানার সামনে বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালায় পুলিশ। সেদিনও পুলিশকে থানা থেকে বেরিয়ে মহাসড়কের দিকে গুলি চালাতে দেখা গেছে। বিবিসি উল্লেখ করে ৫ আগস্টের ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা হয়েছে। এর মধ্যে থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসানের বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ছাড়া ঘটনার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ শুরু হয়েছে।
আন্দোলনকারীদের ওপর গুলির নির্দেশ-সংক্রান্ত শেখ হাসিনার অডিও রেকর্ডের ব্যাপারে বিবিসি উল্লেখ করে, গত ১৮ জুলাই নিজের সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে শেখ হাসিনা ওই ফোনালাপটি করেন। তবে ফোনালাপের অডিওটি কে ফাঁস করেছে তা স্পষ্ট নয়। ফাঁস হওয়া রেকর্ডিংয়ের কণ্ঠের সঙ্গে শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বরের মিল শনাক্ত করেছে বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ। বিবিসি আলাদাভাবে ইয়ারশটের অডিও ফরেনসিক এক্সপার্টদের দিয়ে এই রেকর্ডিংয়ের সত্যতা যাচাই করেছে এবং তারা এটিতে এডিট করার বা কোনোরকম পরিবর্তন করার প্রমাণ পায়নি। ব্রিটিশ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান বিবিসিকে জানান, রেকর্ডিংগুলো শেখ হাসিনার ভূমিকা প্রমাণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এগুলো স্পষ্ট এবং সঠিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে এবং অন্যান্য প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত। তিনি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন, যেখানে শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা চলছে।
জুলাইয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার আইসিসিতে চাইল অ্যামনেস্টি : ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিটি ঘটনার বিচার রোম সনদের ১৪ অনুচ্ছেদ অনুসারে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) পাঠানোর বিষয়টি বিবেচনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। গতকাল ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর এ আহ্বান জানায় যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়া শাখা।
বিবিসির ওই প্রতিবেদনে একটি ফাঁস হওয়া অডিও বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, আন্দোলন দমনে গুলির নির্দেশ দিয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সাউথ এশিয়া ফেসবুক পেজে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের বিক্ষোভে প্রাণঘাতী দমনপীড়নের নির্দেশ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিয়েছিলেন বলে কথিত অডিও-প্রমাণ বিশ্লেষণের পর নতুন তথ্য সামনে এনেছে বিবিসি। এ তথ্যের ভিত্তিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আবারও কর্তৃপক্ষের প্রতি সহিংসতার জন্য দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই ওই সময়ে সংঘটিত সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে একটি স্বাধীন তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে এবং সহিংসতায় অংশগ্রহণকারী ও যারা তা নির্দেশ দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে মৃত্যুদ না দিয়েই ন্যায্য বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অন্তর্বর্তী সরকারকে জোর দিয়ে আহ্বান জানিয়েছে যেন ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট, ২০২৪-এর মধ্যে সংঘটিত ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কাছে রোম সংবিধির ১৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরার বিষয়টি বিবেচনা করে, যা জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনেরও একটি সুপারিশ ছিল।
এর আগে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত জাতিসংঘের একটি তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ওই বিক্ষোভে প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের প্রায় সবাই মারা গেছে বাংলাদেশি নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যবহৃত সামরিক রাইফেল ও শটগানের গুলিতে। আরও হাজার হাজার মানুষ গুরুতর, অনেক ক্ষেত্রেই স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ববরণ করেছে।