Image description
জুলাই ফাউন্ডেশন

তহবিল সংকটে ভুগছে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন। আন্দোলনে নিহত পরিবার ও আহতদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়ার জন্য প্রয়োজন ২৫০ কোটি টাকা। কিন্তু ফাউন্ডেশনটির ফান্ডে রয়েছে ৮ কোটি টাকা। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সিইও কামাল আকবর ও জিএস সামসি-আরা-জামানের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে ফান্ড সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চলছে চিঠি চালাচালি। ফান্ড সংগ্রহে কয়েকটি কোম্পানির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের চেষ্টা চলছে। নতুন কমিটি দায়িত্ব নেয়ার পরে কাউকেই আর অর্থ সহায়তা দেয়া হয়নি। কিন্তু কয়েকবার ঘুরে দ্বিতীয় ধাপের সহায়তার টাকা না পেয়ে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের অফিস কক্ষ ভাঙচুর করেছেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের কয়েকজন জুলাই যোদ্ধা। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগে ফাউন্ডেশনটির অফিস কক্ষে এই ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। গতকাল সরজমিন দেখা যায়, নিরাপত্তার স্বার্থে অফিসের ভাঙচুর হওয়া অংশ মেরামত করে ফেলা হয়েছে। মিডিয়া রুমের ভেঙে ফেলা কাঁচের দেয়ালটি আর প্রতিস্থাপন করা হয়নি। সরিয়ে নেয়া হয়েছে ভেঙে ফেলা বিভিন্ন চেয়ার ও কাঁচের জিনিসপত্র। 

জুলাই আন্দোলনে আহতরা বলছে, ফাউন্ডেশন থেকে দ্বিতীয় ধাপের টাকা দেয়ার কথা বলে ৩ থেকে ৪ বার ঘোরানো হয়েছে। কিন্তু প্রতিশ্রুত তারিখ অনুযায়ী টাকা দিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার টাকা দেয়ার কথা বললে, আমরা সেখানে যাই। কিন্তু  জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামাল আকবর আমাদেরকে বলেন, এখনো সব চেকে স্বাক্ষর করা হয়নি। তাছাড়া চেকে সিইওসহ  মোট ৩ জন কর্মকর্তার স্বাক্ষর লাগলেও বর্তমানে বাকি কর্মকর্তারা উপস্থিত নাই। ফলে টাকা দেয়ার জন্য আগামী রোববার অর্থাৎ ১৩ই জুলাই নির্ধারণ করেন সিইও। পরবর্তীতে ক্ষুব্ধ হয়ে আহতরা অফিসে তালা লাগিয়ে দেন। এর মধ্যে ফাউন্ডেশনের আগত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ’বইঠা’ এর মালিক তাহসিন আহমেদের সঙ্গে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে ভাঙচুরের এই ঘটনা ঘটে।

তাহসিন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, আগামী ৪ঠা আগস্টে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে একটি অনুষ্ঠান হবে। সেখানে আহতদের বিভিন্ন উপহার দেয়া হবে। তারা অনলাইনে গিফটের আইডিয়া চাইলে আমি আমার কিছু প্রোডাক্টের ক্যাটালগ নিয়ে ফাউন্ডেশনে আসি। আমি পড়াশুনার পাশাপাশি ফেসবুক পেইজ ‘বইঠা’-এর মাধ্যমে বিভিন্ন প্রোডাক্ট বিক্রি করি। কিন্তু আমার ক্যাটালগের বক্স দেখে সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষারত জুলাই যোদ্ধারা ভুল বোঝেন। তারা ভাবেন আমি পিৎজা ডেলিভারি দিতে এসেছি। তখন তারা বলে আমরা আহতারা টাকা পাই না আর জুলাই ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা পিৎজা পার্টি দিচ্ছে। তখন তারা আমাকে ‘পিৎজা বয়’ সম্মোধন করলে আমি এর প্রতিবাদ জানাই। এতে ফাউন্ডেশনের কেউ আমার পক্ষ ধরে কথা বললে আহতরা উত্তেজিত হয়ে ভাঙচুর চালান।

সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী ও বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জুলাই যোদ্ধা মো. ওবায়দুল হক মানবজমিনকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে প্রতিশ্রুত অর্থ সহায়তা না পেয়ে তারা আগে থেকেই ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাদের দাবি, গত ৪ঠা জুলাই দ্বিতীয় দফার সহায়তার টাকা দেয়ার কথা বলেন জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সিইও। কিন্তু টাকা দেয়নি ফাউন্ডেশন। এ ছাড়াও সেদিন শুক্রবার থাকায় ফাউন্ডেশন বন্ধ ছিল। পরে ৭ই জুলাই ফাউন্ডেশনে গেলে সিইও মঙ্গলবার টাকা দেয়ার কথা জানান। সেদিন টাকার জন্য জুলাই যোদ্ধারা গেলে, তিন থেকে চার ঘণ্টা অপেক্ষার পর সন্ধ্যার পর সিইও জানান, এখনো সব চেকে স্বাক্ষর করা হয় নাই। আগামী রোববার অর্থাৎ ১৩ই জুলাই টাকা দেয়া হবে। আহতরা এই কথা শুনে ক্ষুব্ধ হয়ে অফিসে তালা লাগিয়ে দেন। এর মধ্যে ফাউন্ডেশনের আগত একজনের সঙ্গে কথা কাটাকাটির একপর্যয়ে সেখানে ভাঙচুর করা হয় বলে তিনি জানিয়েছেন। এ ছাড়াও সেখানে উপস্থিত ক্ষুব্ধ একজন লাথি মারলে ফাউন্ডেশনের কক্ষের কাঁচের দরজার নিচের অংশ ভেঙে যায়। একপর্যায়ে আহতরা আরও ভাঙচুর করেন। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রায় ২০-২৫ জন আহত ব্যক্তি। 

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের ফ্রন্ট ডেস্ক অফিসার তানভীর আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ২০ জনের মতো আহত জুলাই যোদ্ধা মঙ্গলবার দুপুরে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে আসেন। তারা সিইও স্যারের সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের টাকার জন্য চেক দিতে বললে সিইও বলেন, এই মুহূর্তে আমরা কোনো চেক দিতে পারবো না। পরে তারা চলে যায়। সন্ধ্যায় জুলাই যোদ্ধারা কিছু মিডিয়াসহ আবার ফাউন্ডেশনে আসে। এসে তারা একটু উত্তেজিত ব্যবহার করেন। পরে একপর্যায়ে তারা কিছু ভাঙচুর করেন। 

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) সামসি-আরা-জামান মানবজমিনকে বলেন, আমরা দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে কাউকেই আর নতুন করে টাকা দেইনি। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে ১০০ কোটি টাকা এবং অন্যান্য সহায়তা প্রায় ২৫ কোটি টাকা নিয়ে ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’-এর কার্যক্রম শুরু করেছিল। এ পর্যন্ত ৫৫০০ জনের মতো আহত পরিবাকে ১ লাখ টাকা করে অর্থ সহায়তা দেয়া হয়েছে। ৮০৬ জন নিহত পরিবারকে ৫ লাখ টাকা করে দেয়া হয়েছে। এখনো ২৪ জনের মতো শহীদ পরিবারকে তাদের পারিবারিক সমঝোতার অভাবে টাকা দেয়া হয়নি। সমঝোতা হলে তাদেরকে টাকা দেয়া হবে। এদিকে আহতদের মধ্যে ইমাজের্ন্সি বিবেচনায় প্রায় ৫০০ জনকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। 

আমরা নতুন কমিটি প্রায় দেড় মাস হয়েছে যাত্রা শুরু করেছি। বর্তমানে ফাউন্ডেশনের ফান্ডে ৮ কোটি টাকা রয়েছে। আমরা বহুজাতিক কোম্পানি আরএফএল, এসএমই, বিভিন্ন ব্যাংকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে ফান্ড রাইজিং-এর জন্য চিঠি দিয়েছি। সমোঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের চেষ্টা করছি। তারা আমাদের সঙ্গে মিটিং করছেন। তহবিল সংকটের কারণে এখনো অনেক আহত ও নিহত পরিবারকে প্রথম ধাপের টাকা দেয়া যায় নাই। আমরা যদি সবাইকে প্রথম ধাপের অর্থ সহায়তা দেই তাহলে আমাদের আরও ২৫০ কোটি টাকা লাগবে। কিন্তু আমাদের তো এতো টাকা নেই। আমাদের ফান্ড বৃদ্ধি পেলে অফিসিয়ালি সবাইকে টাকা দেয়া শুরু করবো।

দ্বিতীয় ধাপের টাকা না দিয়ে ঘোরানোর অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ওনাদের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা যে জায়গাটা, সেটি পূরণ করা কষ্টকর। আহতদের মধ্যে গুরুতর আহতদের প্রথম ধাপে টাকা দেয়া হয়েছে। যারা এখনো গুরুতর অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন, তাদের মধ্যে ৫০০ জনকে দ্বিতীয় ধাপের টাকা দেয়া হয়েছে। ফান্ড বৃদ্ধি পেলে বাকিদেরকেও টাকা দেয়া হবে। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত সমাধান করার। 

ভাঙচুরের ব্যাপারে কোনো মামলা করবেন না জানিয়ে তিনি বলেন, আহতরা অনেকে মানসিক ট্রমার মধ্যে আছেন। তাদের রাগ ভাঙচুরের ঘটনা একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। তারা ভবিষ্যতে কী করবেন, সেটি নিয়ে হতাশার মধ্যে আছেন। সে কারণে তারা হয়তো ভাঙচুর করেছেন। এটি তাদেরই ফাউন্ডেশন। এ বিষয়ে আমাদের কোনো অভিযোগ নাই।