
"এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না, এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না"—নবারুণ ভট্টাচার্যের এই কবিতা একসময় শুধু সাহিত্য ছিল, কিন্তু একদিন সেটাই হয়ে উঠেছিল আন্দোলনের ভাষা, প্রতিবাদের উচ্চারণ।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের উত্তাল গণঅভ্যুত্থানের সময় এই লাইনগুলো নিজের বক্তব্যে ধারণ করে দেশের মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ড. গোলাম রব্বানী।
সম্প্রতি একটি টক শোতে এসে তিনি স্মৃতিচারণ করেন সেই বিপ্লবী মুহূর্তগুলোর, যখন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জীবন হাতে করে নেমেছিলেন রাস্তায়। “আমি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতেই দাঁড়িয়েছিলাম,”—বললেন তিনি।
তিনি জানান, ১৫ জুলাই ঢাবি ও জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে শুরু হয়েছিল যে আন্দোলন, তা শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, গোটা জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিল। পুলিশের নির্যাতন, এম্বুলেন্সে হামলা, শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি—সবকিছুর মধ্যেও জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীরা ছিলেন রাজপথে অনড়, আর রব্বানী ছিলেন তাদের পাশে।
“আমার চোখের সামনে আমার শিক্ষার্থীদেরকে রক্তাক্ত হতে দেখেছি। তখন একজন শিক্ষক হিসেবে নীরব থাকাটা অপরাধ বলে মনে হয়েছে। যে ছাত্রদের আমরা সন্তান বলি, তাদের ওপর হামলা হলে চুপ থাকা চলে না। আমার হৃদয় কেঁদে উঠেছিল। আমি কাঁদছিলাম,”—বললেন তিনি।
২৯ জুলাই, সেই ঐতিহাসিক দিনের স্মৃতি তুলে ধরে রব্বানী বলেন, “আমার বক্তব্য ছিল মাত্র দুই মিনিটের। আমি চেয়েছিলাম আমার শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, তাদের মুক্তি। আর সেই কথাগুলো বলার জন্য আমি আশ্রয় নিয়েছিলাম কবিতায়, প্রতিবাদের ভাষায়। কবির ভাষায় বলেছিলাম—এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না।”
শুধু ১৫ কিংবা ২৯ জুলাই নয়, পুরো জুলাই মাসজুড়ে ছিল প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও পুনর্জন্মের এক ইতিহাস। বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানরত ছাত্রদের রক্ষা করতে গিয়ে নিজের জীবন বিপন্ন করে যেভাবে শিক্ষকরা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তা বিরল।
তিনি বলেন, “আমার বিরুদ্ধে তখন সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, হয়তো এজন্য যে আমি আগেই এক্সপোজড হয়ে গিয়েছিলাম আন্তর্জাতিকভাবে। কিন্তু আমার সাহসের মূল উৎস ছিল জাহাঙ্গীরনগরের ইতিহাস—এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্য বলার সংস্কৃতি আছে।”
ভবিষ্যৎ শিক্ষক ও তরুণদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “শিক্ষক যদি সত্য বলতে না পারে, তাহলে তার শিক্ষকতা করার কোনো অধিকার নেই। নৈতিকতাহীন শিক্ষা, শিক্ষা নয়।”
অবশেষে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, “আমার স্বপ্ন, এই দেশের সন্তানরা কখনও কারো পরাধীন থাকবে না। তারা নিজেদের মাটি ও মানুষের জন্য কাজ করবে। আর সে লড়াই চলবেই, যতদিন না এই দেশ বৈষম্যমুক্ত হয়।”