
সম্প্রতি ৪৪তম বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করেছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। এরপর থেকেই আলোচনার ঝড় শুরু হয়েছে—’কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুপারিশপ্রাপ্তর সংখ্যা কত?’ প্রশাসন, পররাষ্ট্র বা পুলিশ ক্যাডারের মতো প্রতিযোগিতামূলক পদে কারা শীর্ষে রয়েছেন, তারা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী— এসব বিষয়ও হয়ে ওঠে কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু।
তথ্যমতে, ৪৪তম বিসিএসে বিভিন্ন ক্যাডারে মোট ১ হাজার ৭১০টি শূন্য পদের বিপরীতে ১ হাজার ৬৯০ জন প্রার্থী সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ক্যাডার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয়টি থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১৫৩ জন শিক্ষার্থী বিসিএসে চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। যদিও সুপারিশপ্রাপ্তের এই তালিকায় ‘আলোচিত ক্যাডার’ হিসেবে পরিচিত প্রশাসন, পুলিশ ও পররাষ্ট্র ক্যাডারের একটিতেও শীর্ষস্থানে নেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের কয়েক গ্র্যাজুয়েটকে এই তালিকার প্রথম সারিতে দেখা গেছে।
শুধু ঢাবি নয়, জবি, জাবি, চবিসহ সব জেনারেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাডার সংখ্যা কমেছে। মেডিক্যাল, বুয়েট, রুয়েট, কুয়েটের গ্রাজুয়েটরা জেনারেল ক্যাডারের প্রতি ঝুঁকেছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে স্বাস্থ্য এবং কারিগরি ক্যাডারের পাশাপাশি উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক জেনারেল ক্যাডার হয়েছে। স্বাস্থ্য এবং কারিগরি ক্যাডারে জেনারেল ক্যাডারের মত সুযোগ-সুবিধা দিলে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়াররা জেনারেল ক্যাডার হবে না। তাদের বিশেষায়িত সেক্টরে অবদান রাখবে।—জনপ্রিয় লেখক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এম এম মুজাহিদ উদ্দীন
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ৪৪তম বিসিএসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার অন্যতম কারণ ৪৩তম বিসিএসের চেয়ে কম আসন থাকা। শিক্ষার্থীদের বক্তব্য, ৪৩তম বিসিএসে যেখানে ২,১৬৩ জন প্রার্থীকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল, সেখানে ৪৪তম বিসিএসে এই সংখ্যা নেমে এসেছে ১,৬৯০-এ। ফলে ঢাবি থেকে সুপারিশপ্রাপ্তদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হলেও অনুপাতে হিসাব করলে বিশ্ববিদ্যালয়টি পিছিয়ে নেই বলে দাবি শিক্ষার্থীদের। তবে তথ্যগুলো বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৪৪তম বিসিএসে মোট সুপারিশপ্রাপ্ত ১,৭১০ জনের মধ্যে ১৫৩ জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন; যা শতকরা হিসেবে প্রায় ৮.৯৫ শতাংশ। অন্যদিকে এর আগে ৪৩তম বিসিএস থেকে ২,১৬৩ পদের মধ্যে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন ৩০০ জন শিক্ষার্থী; যা শতকরা হিসেবে প্রায় ১৩.৮৭ শতাংশ। অর্থ্যাৎ পরিসংখ্যান বিচারে এবার প্রায় ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী কম সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্তরা বলছেন, ঢাবি শিক্ষার্থীরা এখন শুধু বিসিএস প্রস্তুতিতে সীমাবদ্ধ নয়; তারা একাধিক ক্ষেত্রে নিজেদের বিকাশে গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাদের মধ্যে বিসিএস পরীক্ষার পাশাপাশি বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ ও স্কলারশিপ অর্জনে আগ্রহ বেড়েছে। পাশাপাশি, সরকারি ও বেসরকারি চাকরি, কর্পোরেট সেক্টর এবং দেশের রাজনৈতিক মঞ্চেও ঢাবি শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। এতে বিসিএস পরীক্ষায় ঢাবি শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ও সুপারিশপ্রাপ্তের সংখ্যা কমতে পারে।
তাদের মতে, এ বছর ঢাবি থেকে ক্যাডার কম হওয়ার আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো ’রিপিট ক্যাডার’। এ বিষয়ে ৪৪ তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত ইকবাল হোসেন সোহান বলেন, আমার কাছে মনে হয়, এবার রিপিট ক্যাডারের বিষয়টি পিএসসি সমাধান না করেই ফল দিয়েছে। রিপিট ক্যাডার পেয়েছেন অনেক ঢাবি শিক্ষার্থী। ফলে যারা নতুন করে পাস করে বের হয়েছেন; তাদের অনেকেই ক্যাডার হওয়ার সুযোগ পাননি। বিভিন্ন ক্যাডারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শীর্ষস্থানে না থাকার কারণ হিসেবে বিসিএস প্রার্থীরা বলেছেন, ভাইভা একটি ফ্যাক্টর হতে পারে। এবার একেক বোর্ডের মার্কিং একেক রকম হয়েছে।
বিসিএস নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখি করেন জনপ্রিয় লেখক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এম এম মুজাহিদ উদ্দীন। তার মতে, শুধু ঢাবি নয়, জবি, জাবি, চবিসহ সব জেনারেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাডার সংখ্যা কমেছে।মেডিক্যাল, বুয়েট, রুয়েট, কুয়েটের গ্রাজুয়েটরা জেনারেল ক্যাডারের প্রতি ঝুঁকেছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে স্বাস্থ্য এবং কারিগরি ক্যাডারের পাশাপাশি উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক জেনারেল ক্যাডার হয়েছে। স্বাস্থ্য এবং কারিগরি ক্যাডারে জেনারেল ক্যাডারের মত সুযোগ-সুবিধা দিলে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়াররা জেনারেল ক্যাডার হবে না। তাদের বিশেষায়িত সেক্টরে অবদান রাখবে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ভাইভা বোর্ডে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা জেলার নাম মিলে গেলে অনেক সময় পরীক্ষকদের ‘সফটনেস’ কাজ করতে পারে। এতে লিখিত পরীক্ষায় নম্বর বেশি পেলেও ভাইভার নম্বরের কারণে অনেকের ক্যাডার না হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। এ কারণেই ভাইভা বোর্ডে পক্ষপাতমূলক আচরণ থেকে বিরত থাকতে পরীক্ষকদের প্রশ্ন করার বিষয়ে এর আগে একাধিক নির্দেশনা দিয়েছিল পিএসসি। এতে বলা হয়, মৌখিক পরীক্ষায় চাকরিপ্রার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম, এমনকি জেলার নামও জানতে চাওয়া যাবে না। পরীক্ষকরা চাকরিপ্রার্থীর রোল নম্বর ছাড়া কিছুই জানতে চাইবেন না। এমন কোনো প্রশ্ন করা যাবে না যা প্রার্থীর প্রতি ভাইভা বোর্ডের কোনো সদস্যের ইতিবাচক বা নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করতে পারে, কিংবা প্রার্থীর ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তরে যদি সেই প্রার্থীর প্রতি পক্ষপাত বা বিরূপ মনোভাব গড়ে ওঠে—সেসব প্রশ্নও করা যাবে না। সে হিসেবে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে আলাদা করে দেখার সুযোগ থাকে না।
যদিও এ বিষয়ে ৪৪তম বিসিএসের একাধিক ভাইভা প্রার্থী জানিয়েছেন, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং ওই বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সরাসরি প্রশ্ন না করলেও বোর্ডের পরীক্ষকদের কাছে মূল সার্টিফিকেটসহ অন্যান্য ডকুমেন্টস থাকে। সেখান থেকে পরীক্ষকরা পরীক্ষার্থী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকেন।
তথ্যমতে, এ বছর ৪৪তম বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্তদের মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) থেকে প্রায় ৬৭ জন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) থেকে ৬২ জন এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) থেকে ২৪ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) থেকে ৮ জন বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশ পেয়েছেন বলে জানা গেছে। এছাড়াও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) থেকে ২৬ জন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) ৩ জন, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি) থেকে ১৬ জন, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (হাবিপ্রবি) ১৩ জন, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) ৫৫ জন, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) ৫৭ জন, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) ৩৬ জন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) ১০ জন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) ৭ জন, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাককানইবি) ১ জন, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (গোবিপ্রবি) ৪ জন, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (মাভাবিপ্রবি) ৯ জন, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালকে (পবিপ্রবি) ৪ জন গ্র্যাজুয়েটের বিসিএস ক্যাডার হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও এই সংখ্যা কমতে বা বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন স্যোশাল মিডিয়ায় জরিপকারীরা।