Image description

অকার্যকর হয়ে আছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। বিগত ১৬ বছর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা কমিশনে বর্তমানে ৮ মাস ধরে নেই চেয়ারম্যানসহ ৭ সদস্য। ফলে মানবাধিকার লংঘন-সংশ্লিষ্ট অভিযোগগুলো পড়ে আছে দিনের পর দিন। অধিকারবঞ্চিত হচ্ছেন ভুক্তভোগীরা।

জানা যায়, ২০০৭ সালে কমিশনটি গঠন করা হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের সদিচ্ছার অভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটি অনেকটাই অচল হয়ে থাকে। গত ১৬ বছরে সরকারের মানবাধিকার লংঘনের বহু গুরুতর ঘটনায় কমিশনে নিযুক্ত হাসিনার কর্তারা ছিলেন রহস্যজনকভাবে নীরব।

আইন অনুযায়ী মানবাধিকার কমিশন একটি স্বাধীন সংস্থা। চেয়ারম্যানের সঙ্গে সদস্য হিসেবে থাকেন সর্বোচ্চ ছয়জন। চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে চেয়ারম্যান তার দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে নতুন চেয়ারম্যান যোগ না দেওয়া পর্যন্ত কিংবা চেয়ারম্যান পুনরায় নিজের দায়িত্ব পালনে সমর্থ না হওয়া পর্যন্ত সার্বক্ষণিক সদস্য চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু বর্তমানে সার্বক্ষণিক সদস্যও নেই।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গণঅভ্যুত্থানের পর গত ৭ নভেম্বর পদত্যাগ করেন মানবাধিকার কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ। একই সময় পদত্যাগ করেন একজন সার্বক্ষণিক সদস্যসহ বাকি ৬ সদস্য। তারা ২০২২ সালের ৮ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সময় নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। গত ১৬ বছরে কমিশনের দায়িত্ব পালন করা অধিকাংশই ছিলেন আমলা। সর্বশেষ চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন ছিলেন বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব। তার পূর্বের চেয়ারম্যান ছিলেন নাসিমা বেগম। তিনিও ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সচিব। একইভাবে তার পূর্বের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয় আরেক সচিব নজরুল ইসলামকে। এভাবে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কমিশনটিকে আমলানির্ভর করে রাখা হয়। একমাত্র চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। যিনি ২০১০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন।

২০১৩ সালের মে মাসে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে স্মরণকালের ভয়াবহ মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে লক্ষ্মীপুরে জেলা জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. ফয়েজ আহম্মদকে নিজ বাড়িতে ঢুকে পরিবারের সামনে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করে র‌্যাব। ২০১৫ সালের ২০ জানুয়ারি খিলগাঁও এলাকায় পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় কথিত ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয় নুরুজ্জামান জনিকে। এমন অসংখ্য বিচারবহির্ভূত খুনের ঘটনা গত ১৬ বছরে ঘটেছে। এ ছাড়া অসংখ্য গুমের ঘটনাও এ সময় ঘটে। আওয়ামী লীগ আমলে এসব মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় মুখে কুলুপ এঁটে রাখে কমিশন।

এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকলেও কমিশনের আইনের নানা দুর্বলতা ও ত্রুটি সংশোধনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার। উপরন্তু রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানটিকে ইচ্ছে করেই অকার্যকর করে রাখা হয়। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে তদন্তের কোনো ক্ষমতাও দেওয়া হয়নি সংস্থাটিকে। এত এত সরকারি ভবন, জায়গা থাকার পরও কমিশনকে দেওয়া হয়নি নিজস্ব কোনো ভবন। কর্মরতদের নেই যথার্থ আর্থিক সুবিধা এবং নেই দক্ষ আইনজীবী প্যানেল। বিমাতাসুলভ আচরণের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর থেকে কমিশনকে ‘বি’ ক্যাটাগরিতেই রেখেছিল আওয়ামী লীগ।

অকার্যকর কমিশন সম্পর্কে উপপরিচালক (অভিযোগ ও তদন্ত) ফারজানা নাজনীন তুলতুল আমার দেশকে বলেন, পুরো কমিশন দায়িত্বে থাকলে দেওয়ানি আদালতের ক্ষমতাবলে মানবাধিকার লংঘনের বিভিন্ন বিষয় কমিশন নিজেদের উদ্যোগে তদন্ত করতে পারে। বর্তমানে প্রাপ্ত অভিযোগগুলো আমরা শুধু লিখে রাখছি। কমিশনের চারটি বেঞ্চ রয়েছে। অভিযোগগুলো নিয়ম অনুযায়ী বেঞ্চে ওঠে। কমিশন সদস্যরা থাকলে তদন্ত করা এবং নির্দেশনা তারা দিতে পারেন। কিন্তু সেই কাজটিও এখন বন্ধ রয়েছে।

কমিশন কর্মকর্তারা জানান, ২০২৪ সালে ৭৫১টি অভিযোগ পেয়েছিল মানবাধিকার কমিশন। আর এ বছর জুন পর্যন্ত ৩ শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। চেয়ারম্যান ও সদস্যদের পদ শূন্য থাকায় প্রাপ্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলোর ব্যাপারে কমিশন কিছুই করতে পারছে না। এমনকি সুয়োমোটো (স্বপ্রণোদিত) অভিযোগের প্রতিকার বা সমাধানের পথও রুদ্ধ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে সরাসরি কোনো দণ্ড দেওয়ার ক্ষমতা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নেই। রাষ্ট্রের মানবাধিকার লঙ্ঘনে প্রতিষ্ঠানটি শুধু তার কণ্ঠ উচ্চকিত করতে পারে, সুপারিশ করতে পারে। তবে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমসহ বড় ধরনের মানবাধিকার লংঘন প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যায়নি প্রতিষ্ঠানটিকে। এ নিয়ে মানবাধিকারকর্মীরা নানা সময়ে সমালোচনাও করেছেন। এর মধ্যে চেয়ারম্যানসহ বোর্ড সদস্যরা না থাকায় কমিশনে দাপ্তরিক কাজ চলছে কোনোমতে। কবে নাগাদ কমিশন পুরোদমে আবার শুরু করতে পারবে, তাও কেউ বলতে পারছেন না।

বর্তমানে দায়িত্ব পালনকারী সংস্থার সচিব সেবাস্টিন রেমা আমার দেশকে বলেন, চেয়ারম্যান-সদস্যরা কবে নিয়োগ পাবেন, তা সরকারি সিদ্ধান্ত। এখন আমরা শুধু অভিযোগই নিচ্ছি। কমিশন সদস্যরা না থাকায় সমাধানের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। কমিশনের মূল যে কাজ, অর্থাৎ অভিযোগের ওপর শুনানি, সুপারিশÑএগুলো এখন করা যাচ্ছে না। আমরা শুধু রুটিনওয়ার্ক করছি।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের মানবাধিকারবিষয়ক উপদেষ্টা এবং মিডিয়া সেল ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার আবু সায়েম আমার দেশকে বলেন, আওয়ামী লীগের সময় কমিশনে নিযুক্ত দলকানা অদক্ষ আমলারা দেশের মানবাধিকার সুরক্ষায় কিছুই করেননি। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এ সংস্থাটির অনেক কিছুই করার ছিল। বর্তমানে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চায় সাংবিধানিক এ সংস্থাটিকে কাজে লাগানোর সুন্দর সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমি মনে করি, মানবাধিকার কমিশনকে কার্যকর ও নিরপেক্ষ রাখতে জাতীয় ঐকমত্য থাকা দরকার। সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় সুফল পৌঁছে দিতে এটির সক্ষমতা বাড়ানো এবং নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ-সংবলিত আইনি সংশোধন প্রয়োজন। পাশাপাশি কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগে এ বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দক্ষদের কাজে লাগানো উচিত।

মানবাধিকার সংগঠন লাইট হাউসের আহ্বায়ক এম সাইফুল্লাহ এ প্রসঙ্গে আমার দেশকে বলেন, ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন’ নামে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান আছে। এর জন্য বাজেট আছে, অফিস আছে, কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে; কিন্তু নেই কোনো কর্মকাণ্ড। এই সংস্থা প্রতিষ্ঠার পর থেকে কখনোই এ দেশের মানবাধিকারবঞ্চিত মানুষগুলো দেখতে পায়নি এদের কোনো কর্মকাণ্ড। একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে আমরা নখ-দন্তহীন কোনো কমিশন নয়, সাহসী-উদ্যমী ও কর্মঠ মানবাধিকার কমিশন চাই।

এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সচিব ড. হাফিজ আহমেদ চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে। আশা করি নিয়োগ প্রক্রিয়া শিগগির হয়ে যাবে। তবে এখনো পর্যন্ত বলার মতো অগ্রগতি নেই।