Image description

রাজবাড়ী জেলায় মোট দুটি নির্বাচনি আসন। এর মধ্যে সদর ও গোয়ালন্দ উপজেলা নিয়ে রাজবাড়ী-১ এবং পাংশা, বালিয়াকান্দি ও কালুখালী- এই তিন উপজেলা নিয়ে রাজবাড়ী-২ আসন। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ইতোমধ্যে ভোটের মাঠে সরব হয়েছেন সম্ভাব্য প্রার্থী ও মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। দুই আসন মিলিয়ে বিএনপিতে এবার মনোনয়নপ্রত্যাশীর ছড়াছড়ি। জেলায় এখন পর্যন্ত বিএনপির ১১ জন মনোনয়নের দাবিদার। এর মধ্যে কেবল রাজবাড়ী-২ আসনেই মনোনয়নপ্রত্যাশী সাতজন। অন্যদিকে একক প্রার্থী চূড়ান্ত করতে পারায় অনেকটা নির্ভার হয়ে প্রচারে নেমেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা।

রাজবাড়ী জেলা বরাবরই আওয়ামী বিরোধীদের ঘাঁটি। ১৯৭৩-৭৪ সালে রক্ষীবাহিনীর নির্যাতনের স্মৃতি রাজবাড়ীর মানুষ এখনো মনে রেখেছে। এক সময়ের বাম ঘরানার জনপদ বলে পরিচিত এ জেলায় রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারের দুঃসহ স্মৃতি প্রবীণদের মনে এখনো নাড়া দেয়। তারই ধারাবাহিকতায় এবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ভোটের মাঠের মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে।

মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই জেলায় বিএনপির কমিটি নিয়ে অন্তর্কোন্দল রয়েছে, নির্বাচনের আগে এর সমাধান না হলে ভোটের মাঠে দলকে ভোগাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অন্যদিকে একক প্রার্থী নিয়ে দলীয় প্রচারে ব্যস্ত রয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা। সংশ্লিষ্টরা জানান, একাধিক প্রার্থী না থাকায় দলটির নির্বাচনি প্রচার ও প্রার্থীদের থেকে অনিশ্চয়তা দূর হওয়ায় ভোটের মাঠে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারবে দলটি।

বিএনপির দলীয় সূত্রে জানা গেছে, রাজবাড়ী জেলায় দলটির রাজনীতি চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। এ কমিটি ৬ বছর পার করলেও নানা জটিলতায় পূর্ণাঙ্গ হয়নি। এ জটিলতার মূল কারণ গ্রুপিং রাজনীতি। জেলা কমিটির আহ্বায়ক লিয়াকত আলী বাবু ও সদস্যসচিব কামরুল আলম রতন জানান, পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার জন্য কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যন ড. এসএম আসাদুজ্জামান রিপনকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও কার্যত অগ্রগতি নেই।

সূত্র জানায়, বিএনপির একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন সাবেক এমপি আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম, অপরটি আসলাম মিয়া। আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব দুজনই আসলাম মিয়াকে সমর্থন করেন। এসব দ্বন্দ্ব ও সংক্ষুব্ধ অবস্থায় দলীয় মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে বিএনপিকে মেলাতে হচ্ছে নানা সমীকরণ।

রাজবাড়ী-১ (সদর ও গোয়ালন্দ)

রাজবাড়ী-১ আসনের বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী চার নেতা ইতোমধ্যে ভোটের মাঠে সক্রিয় হয়েছে। এদের মধ্যে একজন সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) ও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম। এর আগে তিনবার রাজবাড়ী পৌরসভার মেয়র ছিলেন তিনি।

রাজবাড়ী অংকুর স্কুল ও কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ খৈয়ম জুলাই বিপ্লবের আগে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের নির্যাতনের শিকার নেতাকর্মীদের চাঙা করতে নানা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। ইউনিয়ন ও পৌরসভার নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত সভা করে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। বিভিন্ন পেশাজীবী ও শ্রেণি-পেশার লোকদের নিয়ে নিয়মিত মতবিনিময় করছেন। আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম বলেন, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আশীর্বাদ পেলে এলাকার মানুষের সেবা করার জন্য জীবন উৎসর্গ করবেন।

এই আসনে খৈয়মের পাশাপাশি বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ও রাজবাড়ী জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আসলাম মিয়া। জুলাই-পরবর্তী সময়ে দল গোছানো থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় ও বিভাগীর কর্মসূচি পালন করে চলেছেন। আসলাম মিয়া জানান, মনোনয়ন পেলে ও বিজয়ী হলে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু, দৌলতদিয়া ঘাট এলাকা বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠার বিষয়ে উদ্যোগী হবেন।

একই আসনে বিএনপির আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা বিএনপি আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মো. আব্দুস সালাম মিয়া। বিগত ফ্যাসিস্ট বিরোধী আন্দোলনে অন্য নেতা-কর্মীর মতো তিনিও সব সময় মাঠে ছিলেন। সব মুভমেন্টে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। তিনিও বিএনপি মনোনয়ন প্রার্থী।

এ ছাড়া আসনটিতে বিএনপির মনোনয়ন চান মনিরুজ্জামান গাজী মানিক। এ লক্ষ্যে তিনি নিয়মিত গণসংযোগ করছেন। ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি মানিক বর্তমানে রাজবাড়ী জেলা বিএনপির সদস্য। ফ্যাসিস্ট হাসিনার সময়ে দুই বছরের বেশি সময় কারাগারে ছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে ২৫টি মামলা রয়েছে।

এদিকে এই আসনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর একক প্রার্থী আইনজীবী মো. নূরুল ইসলাম। তিনি জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য ও জেলা আমির। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচন ও ১৯৯৩ সালের উপনির্বাচনে তিনি প্রার্থী হয়েছিলেন। তিনি রাজবাড়ী ও গোয়ালন্দ উপজেলায় বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করে চলেছেন।

নূরুল ইসলাম বলেন, মানুষ পরিবর্তন চায়। অনেক দিন বড় বড় দলের শাসন ও দুঃশাসন দুটিই দেখেছে। কিন্তু শান্তি পায়নি। দুর্নীতি ও অপশাসনে পুরো দেশ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু জামায়াতের বিরুদ্ধে কেউ দুর্নীতির অভিযোগ তুলতে পারেনি। তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে; তাই জামায়াতের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য তারা একতাবদ্ধ হবে। তিনি আরো বলেন, সৎ মানুষের শাসন সবাই দেখতে চায়। জামায়াত ক্ষমতায় গেলে কারো কোনো দাবি করতে হবে না। রাষ্ট্রীয়ভাবেই সব সমস্যার সমাধান হবে।

দল ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গেছে, জামায়াতের একক প্রার্থী থাকায় দলীয় কোনো বিরোধ নেই। এটা এই আসনের প্রার্থী নূরুল ইসলামের বাড়তি সুবিধা বলে মনে করেন তারা।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। রাজবাড়ী-১ আসনের প্রার্থী বিভিন্ন এলাকায় ব্যানার ও পোস্টার সেঁটেছেন। তারা বিভিন্ন উপজেলায় সভা-সমাবেশ করলেও প্রার্থী নির্বাচনে কোনো সিদ্ধান্ত এখনো পাননি।

গণঅধিকার পরিষদ ও ছাত্রদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) এখনো কোনো কমিটি হয়নি। দল দুটি এখনো ছাত্র সংগঠননির্ভর।

রাজবাড়ী-২ (পাংশা, কালুখালী ও বালিয়াকান্দি)

আসনটি এতদিন মূলত বিএনপি ও ইসলামী মূল্যবোধসম্পন্ন সমর্থকদের আসন। এবার এই আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী অন্তত সাতজন। আর একক প্রার্থী নিয়ে নির্ভার প্রচারে জামায়াতে ইসলামী।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই আসনে সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশীর মধ্যে রয়েছেন সাবেক এমপি ও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নাসিরুল হক সাবু। তিনি বর্তমানে অনেকটা অসুস্থ। তার পক্ষে ছোট ভাই মাহমুদুল হক রোজেন ও হাবিবুর রহমান রাজা (ভিপি রাজা) প্রচার চালাচ্ছেন। রাজা বলেন, সাবেক এমপির শারীরিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়, আমরা তার জন্য লড়ে যাব। তার পক্ষে এলাকার বিপুলসংখ্যক মানুষের সমর্থন আছে।

এদিকে সাবুর বিকল্প হিসেবে দলীয় মনোনয়ন চাইবেন তার ভাই মাহমুদুল হক রোজেন। সাবেক অধ্যক্ষ ও সাবেক উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ছিলেন রোজেন। ভাইয়ের স্বপ্ন পূরণে কাজ করতে চান জানিয়ে দলীয় নানা কর্মসূচি পালন করে চলেছেন তিনি।

বিএনপির জেলা কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদও এ আসনে অন্যতম প্রার্থী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, এখনো গণসংযোগের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছেন। তিনি জানান, নির্বাচনি এলাকায় নিয়মিত সভা-সমাবেশ ও ভোটারদের সংগঠিত করে নিয়মিত কাজ করে চলেছেন।

এই আসনে বিএনপির আরেকজন মনোনয়নপ্রত্যাশী আইনজীবী লিয়াকত আলী বাবু। জেলা বিএনপির আহ্বায়ক বাবুর স্ত্রী দীর্ঘদিন রোগভোগের পর সম্প্রতি ইন্তেকাল করেন। স্ত্রীর দুরারোগ্য ব্যাধির পরও দলীয় কর্মকাণ্ড বিঘ্নিত হতে দেননি তিনি।

এই আসনে বিএনপির অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন বিশিষ্ট শিল্পপতি মো. মুজাহিদুল ইসলাম। পাংশা উপজেলার সাবেক ছাত্রদল নেতা মুজাহিদ দীর্ঘদিন ধরে পাংশা-২ আসনের বিএনপি প্রার্থী হওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। পাংশা-বালিয়াকান্দি ও কালুখালীর বিভিন্ন এলাকায় কর্মসূচি ও গণসংযোগ করছেন। এছাড়া এই আসনে অন্য দুই মনোনয়ন প্রত্যাশী হলেন বালিয়াকান্দির বহর ইউনিয়ন পরিষদের কয়েকবারের চেয়ারম্যান মো. আবুল হোসেন খান এবং ব্যারিস্টার গাজী রহমান মানিক।

এদিকে রাজবাড়ী-২ আসনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর একক প্রার্থী মো. হারুন অর রশিদ। তিনি অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক। জেলা জামায়াতের সাংগঠনিক সম্পাদক। ১৯৯১ সালে রাজবাড়ী-২ আসনে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে বিজয়ী হয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত ডা. একেএম আসজাদ হোসেন। তিনি জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলেও তার এক সন্তান ডা. ইকবাল আর্সলান আওয়ামী রাজনীতির মতাদর্শীর সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের মহাসচিব ছিলেন।

এই আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কোনো প্রার্থী এখনো ঘোষণা করা হয়নি।

এই আসনে জামায়াতের জনপ্রিয়তা কমবেশি থাকলেও তাদের দলীয় প্রার্থী মো. হারুন অর রশিদ নির্বাচনের মাঠে থাকা অন্য দলের প্রার্থীদের তুলনায় কম পরিচিত। এ ছাড়া তাকে সামাজিক কর্মকাণ্ডে কম দেখা যায় বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।