
নাটোরের আকাশে নেমে এসেছে ঘন বিষাদের ছায়া। মল্লিকহাটি গ্রামের বাতাসে ভাসছে পিতার আর্তনাদ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে ফেসবুক প্রোফাইল লাল করেছিলেন যে কিশোর, আজ তার দগ্ধ মরদেহ শুয়ে আছে শীতল মাটির নিচে।
তার নাম ইয়াসিন আলী। বয়স মাত্র ১৬ বছর। সে ছিল নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী, দিনমজুরের ছেলে, আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। শহীদদের প্রতি ভালোবাসা জানাতে নিজের ফেসবুক প্রোফাইল রঙিন করেছিল লাল রঙে। আর সেই ভালোবাসাই হয়ে উঠেছিল তার মৃত্যুর কারণ।
৪ আগস্ট ২০২৪—যখন অন্য কিশোররা বইয়ে ফিরে গিয়েছে, ভয় আর শঙ্কার মধ্যে আন্দোলনের পথ থেকে সরে গেছে, তখন ইয়াসিন নিখোঁজ হয়। পরিবার থানায়, হাসপাতালে, বন্ধুদের কাছে ছুটে বেড়ায়। কেউ জানে না কোথায় সে।
৬ আগস্ট সন্ধ্যায়, নাটোর-২ আসনের সাবেক এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুলের ব্যক্তিগত বাসার বেডরুম থেকে উদ্ধার হয় আগুনে পোড়া একটি লাশ। পিতা ফজর আলী নিশ্চিত করেন— সেটিই তার প্রিয় পুত্র ইয়াসিনের নিথর দেহ।
ইয়াসিনের বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। সে ছিল না কোনো অপরাধী। ছিল কেবল একটি জেগে থাকা বিবেক, একটি প্রতিবাদী মন। পরিবার ও সহপাঠীদের ভাষ্যমতে, স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র ও যুবসংগঠনের কিছু নেতাকর্মী তার ওপরে ক্ষিপ্ত ছিল। কারণ সে শহীদদের স্মরণে ফেসবুক প্রোফাইল লাল করেছিল। কারণ সে লিখেছিল, ‘অন্যায়কারীরা যত শক্তিশালী হোক, আমরা মাথা নোয়াবো না।’
তারা ইয়াসিনকে হুমকি দেয়, মারধর করে, মোবাইল কেড়ে নেয়। তারপর সেই নির্দয় পরিণতি। পিতা ফজর আলী কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘ছেলেটা কাঠের দোকানে আমার সাথে কাজ করতো। খুব ভালো পড়তো। বলতো, ‘বাবা, আমি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবো।’ আমি কী করে ভাবতাম সেই কথাই তার জীবন কেড়ে নেবে!’ মা রত্না বেগম কোনো কথা বলতে পারেন না। শোকে নীরব হয়ে গেছেন। তার চোখের পানি যেন এখন পুরো গ্রামকে ভিজিয়ে দিচ্ছে।
নাটোর জুড়ে নেমে এসেছে এক শোকস্তব্ধতা। প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ, মানবাধিকারকর্মী এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। তাদের একটাই দাবি— ‘ইয়াসিনের হত্যার বিচার চাই। আজ যদি বিচার না হয়, কাল আরও ইয়াসিন এভাবেই হারিয়ে যাবে।’
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে থামাতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপীড়ন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।