
বর্তমানে দেশের মেডিকেল শিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধেকই ( ৪২ % ) ভর্তি হচ্ছে সরকারি কলেজগুলোতে । অথচ বিদ্যমান ৩৭ টি সরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষকের তীব্র সংকট চলছে । বিশেষ করে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকসহ মোট পদের ৪৩ শতাংশই খালি । সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন , এতে শিক্ষার্থীদের শিখন ও প্রশিক্ষণে ঘাটতি থাকছে । মানসম্মত চিকিৎসক তৈরিতে থেকে যাচ্ছে বড় ধরনের দুর্বলতা । স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী , সরকারি চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়গুলোতে প্রতি শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস ও বিডিএস ( ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারি ) ডিগ্রিতে ৫ হাজার ৩৮০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয় । এ ছাড়া পুরোনো কয়েকটি কলেজে রয়েছে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ডক্টর অব মেডিসিন ( এমডি ) , মাস্টার্স অব সার্জারি ( এমএস ) , এফসিপিএস , এমফিল ও ডিপ্লোমা ডিগ্রি ।
সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী , সরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষকের অনুমোদিত পদের মধ্যে ৪৩ শতাংশ খালি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর । তথ্য বলছে , শিক্ষকের ৬ হাজার ৩৮৪ টি পদের মধ্যে খালি রয়েছে ২ হাজার ৭২৫ টি । সবচেয়ে বেশি খালি অধ্যাপক পদে । পদের বিপরীতে ৬৪ শতাংশ অধ্যাপক নেই কলেজগুলোতে । অধ্যাপকের ৮৭৭ টি পদের বিপরীতে ৫৬৫ টিই খালি । সহযোগী অধ্যাপকের ১ হাজার ৬৩৪ টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে খালি ৭৩৫ টি বা ৪৫ শতাংশ ।
২ হাজার ৪৫৩ টি সহকারী অধ্যাপক পদের বিপরীতে ১ হাজার ২৫৩ টি পদ খালি রয়েছে , যা পদের ৫১ শতাংশ । সবচেয়ে কম খালি প্রভাষকের পদ । মোট ১ হাজার ৪২০ টি প্রভাষক পদের বিপরীতে ১৭২ টি শূন্য রয়েছে । অবকাঠামোগত ঘাটতি , শিক্ষক এবং প্রশিক্ষণ সুবিধার স্বল্পতার মধ্যেও বিভিন্ন সময় মেডিকেল কলেজগুলোতে আসনসংখ্যা বাড়িয়েছে সরকারের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ । ২০০৯ সাল পর্যন্ত দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজ ছিল ১৭ টি । এরপর দেড় দশকে আরও ২০ টি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছে সরকার । পরিসংখ্যান অনুযায়ী , অপেক্ষাকৃত নতুন এবং বড় শহরের বাইরের মেডিকেল কলেজগুলোতে শিক্ষকসংকট বেশি । ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের সবচেয়ে পুরোনো মেডিকেল শিক্ষায়তন ঢাকা মেডিকেল কলেজে মোট শিক্ষকের পদ রয়েছে ৪৮৭ টি । এগুলোর মধ্যে শূন্য রয়েছে ১৪৫ টি ।
শিক্ষকসংকটের কারণে শিক্ষার মান ধরে রাখা কঠিন হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন কলেজটির অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা . মো . কামরুল আলম । আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন , মেডিকেল কলেজের তুলনায় অন্যান্য মেডিকেল কলেজে শিক্ষকসংকট বেশি । অনেকগুলো মেডিকেল কলেজ রয়েছে , যেখানে অনুমোদিত পদও পর্যাপ্ত নয় । তারও প্রায় অর্ধেক খালি । পদোন্নতি হচ্ছে না । ’ রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ৩৭৭ টি শিক্ষকের পদের বিপরীতে খালি ১৪৭ টি । মহাবিদ্যালয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক ছাড়াও স্নাতকোত্তর (এমএস, এমডি , এমপিএইচ , এমফিল) ও ডিপ্লোমা ডিগ্রি দিচ্ছে ।
কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা . খন্দকার মো . ফয়সল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন , প্রতি মাসেই তাঁরা কর্তৃপক্ষকে প্রতিবেদন পাঠান । প্রতি মাসেই কেউ না কেউ অবসরে যান বা বদলি হন । অধ্যক্ষ বলেন , “ মূলত শিক্ষকের সাবজেক্টের পদ ধরা হয় সহকারী অধ্যাপক থেকে । ক্লিনিক্যাল সায়েন্সে না থাকলেও আমাদের বেসিক সায়েন্সে শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে । প্রভাষকেরা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে অনেকে পদোন্নতির যোগ্য হয়েছেন ; কিন্তু পদোন্নতি হচ্ছে না । পদোন্নতি না হওয়ার কারণে প্রভাষকেরা প্রশ্ন প্রণয়ন , পরীক্ষা গ্রহণের কাজে আসছেন না ।'
অধ্যাপক মো . ফয়সল আলম আরও বলেন , স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পরও একজন চিকিৎসক ১০ বছর ধরে প্রভাষকই রয়েছেন । এতে শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা জন্ম নিচ্ছে । যেসব বিষয়ে শিক্ষকসংকট বেশি , সেসব বিষয়ে স্নাতকোত্তরের একাডেমিক কার্যক্রম চালানো খুবই কঠিন । চিকিৎসা পেশার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের ( বিএমডিসি ) কথায় , মেডিকেল কলেজে একাডেমিক কার্যক্রম চালাতে ন্যূনতম ১১ টি বিষয় থাকা বাধ্যতামূলক । বিষয়গুলো হলো অ্যানাটমি , ফিজিওলজি , বায়োকেমিস্ট্রি কমিউনিটি মেডিসিন , ফরেনসিক মেডিসিন , ফার্মাকোলজি , প্যাথলজি , মাইক্রোবায়োলজি , সার্জারি , মেডিসিন এবং গাইনি ও অবস্টেট্রিকস ।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এমবিবিএস ও বিডিএস ডিগ্রি দেওয়া হয় , সেগুলোর একটি সাধারণ নীতিমালা হলো , প্রতি ১০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে ১ জন শিক্ষক থাকতে হবে । আর প্রতি ২৫ শিক্ষার্থীর জন্য ন্যূনতম একজন পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারী শিক্ষক থাকতে হবে । ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে ১৮৬ টি শিক্ষকের পদের বিপরীতে শূন্য রয়েছে ১০৫ টি । অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা . শেখ সাদেক আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ একাডেমিক কার্যক্রম যেন বাধাগ্রস্ত না হয় , তার জন্য শিক্ষকেরা বিকেলে বা রাতেও ক্লাস নিচ্ছেন । রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিংয়ে কোনো শিক্ষকই নেই , ফরেনসিক মেডিসিনে আছেন মাত্র একজন । ”
২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করেছে সুনামগঞ্জ মেডিকেল কলেজ । বর্তমানে এর আসনসংখ্যা ৭৫ টি । শিক্ষকের পদ ৮৭। এর মধ্যে ৫৯ টি পদই শূন্য । অর্থাৎ মোট পদের বিপরীতে ৬৮ শতাংশ শিক্ষকই নেই কলেজটিতে । শিক্ষকসংকটের মধ্যে কীভাবে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে , এমন প্রশ্নে কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা . মোস্তাক আহম্মদ ভূইয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন , ' এ সংকট দীর্ঘদিনের । শিক্ষকেরা দ্বিগুণ ক্লাস নিয়ে কারিকুলাম শেষ করেন । শিক্ষকসংখ্যা পর্যাপ্ত হলে একাডেমিক কার্যক্রম অনেক সুন্দর হতো । কিছু বিষয়ের শিক্ষক অতি জরুরি । '
বিশেষজ্ঞদের তাগিদ চিকিৎসা শিক্ষার মান বজায় রেখে মানসম্মত চিকিৎসক তৈরির জন্য অবকাঠামোর পাশাপাশি শিক্ষক , পরীক্ষাগার ও প্রশিক্ষণের মতো বিষয়গুলো অত্যাবশ্যকীয় বলে মত দিয়েছেন চিকিৎসা শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা । তাঁরা বলছেন , সরকার কলেজের সংখ্যা ও আসন বাড়ানোয় নজর দিলেও শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে কার্যত উদাসীনতা দেখিয়েছে । মেডিকেল কলেজে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতিতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বেশি ।
ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিকেল এডুকেশনের ( ডব্লিউএফএমই ) সাবেক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ( ডব্লিউএইচও ) দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা . মোজাহেরুল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ সরকারি চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূরণ করতে পারছে না । সরকার প্রয়োজন নিরূপণ না করে যত্রতত্র মেডিকেল কলেজ করেছে । মেডিকেল কলেজ যে পর্যায়ের বা যে স্থানেই হোক না কেন , সব কটির মান একই হওয়া প্রয়োজন । কিন্তু মান নিয়ে সরকারকে কখনোই পরিকল্পনা করতে দেখা যায়নি । শিক্ষক ঘাটতিসহ একাডেমিক কার্যক্রমে যেকোনো সংকট শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে । মানসম্মত যুগোপযোগী চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে না । স্বাস্থ্যসেবার মানের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ছে । ’
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
স্বাস্থ্য শিক্ষা শিক্ষা অধিদপ্তর বলছে , স্নাতকোত্তর ডিগ্রি না থাকলে কেউ সহকারী অধ্যাপক হতে পারেন না । সহকারী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পদ পর্যন্ত যেতে কয়েক বছর চাকরি করা এবং গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশের মতো কিছু শর্ত পূরণ করার বিষয় থাকে । বর্তমানে পদের সংকট নেই । তবে পদোন্নতিপ্রক্রিয়ায় ধীরগতির কারণে শিক্ষকসংকট তৈরি হয়েছে ।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা . নাজমুল হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘নীতিমালা মেনে পদোন্নতি দিতে হয় । বেসিক সায়েন্সের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়া চিকিৎসকের সংখ্যা খুব কম । নতুন করে বেসিক সায়েন্সের বিষয়গুলোয় স্নাতকোত্তর পড়ার আগ্রহও কম দেখা যাচ্ছে । গত কয়েক মাসে নানা কারণে পদোন্নতির প্রক্রিয়াটি এগোয়নি । এখন স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে । স্বল্পমেয়াদি চলতি দায়িত্বে কিছু পদোন্নতি দেওয়ার প্রক্রিয়া রয়েছে । অন্যদিকে স্বাভাবিক পদোন্নতির জন্য মন্ত্রণালয়কে তাগাদা দেওয়া হচ্ছে । ' ডা . নাজমুল হোসেন আরও জানান , বেসিক সায়েন্সের শিক্ষকদের শতভাগ প্রণোদনা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে । অর্থ বিভাগ আপত্তি দিয়ে ৫০ শতাংশের কথা বলেছে । এটা বাড়াতে আবার বলা হয়েছে । অন্যদিকে বেসিক সায়েন্সের বিষয়গুলোতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির ক্ষেত্রে বৃত্তি দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে । এসব উদ্যোগে চিকিৎসকেরা উৎসাহ পাবেন । এ ছাড়া নতুন বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডাররা যোগদান করার পর তাঁদের কিছুসংখ্যককে সরাসরি ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজগুলোয় পদায়ন করা হলে সংকট কিছুটা কাটবে ।