
পৃথক সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে উপস্থিত সব রাজনৈতিক দলই নীতিগতভাবে সমর্থন দিয়েছে। প্রধান বিচারপতির প্রস্তাবের পর এ-সংক্রান্ত অধ্যাদেশের খসড়াও প্রস্তুত হয়ে আছে বেশ আগে থেকেই। এরপরও আটকে আছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কাজ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর আগে রাজনৈতিক সরকারগুলো বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়ন করেনি। ভবিষ্যতে যে করবে সে নিশ্চয়তাও নেই। তাই এ অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ই পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য একটি ভালো সময়। অথচ অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় নেই বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয়।
এদিকে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় বিষয়টি স্থান না পাওয়াকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সংগঠন জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। সম্প্রতি রংপুরে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় সংগঠনের নেতারা বলেন, বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করার এখনই উপযুক্ত সময়। এ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর বিচার বিভাগীয় সচিবালয় অপরিহার্য। সর্বশেষ গত ২২ জুন ‘বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা ও দক্ষতা’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনারে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা না আসায় হতাশ হয়েছেন বিচারকরা। তারা বলেন, প্রধান উপদেষ্টা পৃথক সচিবালয়ের গুরুত্ব তুলে ধরে বক্তব্য দিলেও সুস্পষ্ট ঘোষণা দেননি। ফলে শিগগিরই এ সচিবালয় হবে বলে আর মনে হচ্ছে না।
অন্যদিকে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ একটি বাধা বলে মনে করেন এ-সংক্রান্ত রিটকারীদের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের বিচারক ও বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ এবং শৃঙ্খলা বিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করার কথা বলা হয়েছে। ১১৬ অনুচ্ছেদ বর্তমান অবস্থায় বহাল রেখে পৃথক সচিবালয় করলে তা সাংঘর্ষিক হবে। তিনি বলেন, এর ফলে আমরা বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে রিট করেছি। আমরা আদি সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনার আর্জি জানিয়েছি। এখন রুল শুনানি হচ্ছে। তবে এ রুল শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ বারবার সময় নিচ্ছে। এভাবে বারবার সময় নেওয়া সমীচীন নয়। আদালতের কাজে সবাই সহযেইগতা করবেন বলেও আশা প্রকাশ করেন সুপ্রিম কোর্টের এ আইনজীবী।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর সারা দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে অভিভাষণে বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের মতো বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব শিগগিরই আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। এরপর সুপ্রিম কোর্ট থেকে গত বছরের ২৭ অক্টোবর এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবের সঙ্গে ধারণাপত্র ও খসড়া অধ্যাদেশ পাঠানো হয় আইন মন্ত্রণালয়ে। এরপর বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনেও পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সুপারিশ করা হয়। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আইন মন্ত্রণালয় অধ্যাদেশের খসড়াসহ প্রায় সবই চূড়ান্ত করে রেখেছে। এখন অর্ন্তবর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নিলেই অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে পৃথক সচিবালয় করতে পারে।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও স্পেশাল অফিসার মো. মোয়াজ্জেম হোছাইন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পৃথক সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় আমাদের পক্ষ থেকে ধারণাপত্রসহ প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছিল। আমরা আশাবাদী সরকার খুব শিগগিরই এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের অন্যতম সদস্য ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলার বাদী ও সাবেক জেলা জজ মাসদার হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের বিচার বিভাগ যুগ যুগ ধরে পরাধীন ও সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ছিল। এর ধারাবাহিকতা এখনো রয়েছে। এখনো বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি, শৃঙ্খলাসংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় সরকারের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। অথচ মাসদার হোসেন মামলার মূল উদ্দেশ্যই ছিল বিচারকদের সরকারের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করা। তিনি বলেন, ওই মামলার রায়ের ১২ দফা নির্দেশনার ৮ নম্বর দফায় স্পষ্ট করে বলা ছিল বিচারকদের সংসদ তথা আইন বিভাগ ও প্রশাসনের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ মুক্ত রাখতে হবে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় বিচার বিভাগ পৃথককীকরণের ১৭ বছর পরও ওই রায়ের অনেক নির্দেশনা অকার্যকর রয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় প্রধান বিচারপতির উদ্যোগ ও প্রস্তাবনা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। আমি মনে করি স্বাধীন বিচার বিভাগ বিনির্মাণে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের ৮ নম্বর দফার আলোকে বিচার বিভাগকে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা সময়ের দাবি।
পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় একমত সব রাজনৈতিক দল : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে উপস্থিত সব রাজনৈতিক দল ৮টি বিষয়ে একমত হয়েছে। এই ৮ প্রস্তাব হচ্ছে- নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ কার্যকরভাবে পৃথককরণের জন্য সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা এবং প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা। বিচারকদের চাকরির নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত করার জন্য সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ ও সংশ্লিষ্ট বিধিমালা সংশোধন করার সুপারিশের বিষয়ে একমত পোষণ করেছে সব দল। বিচারকদের রাজনৈতিক আনুগত্য প্রদর্শন বা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশকে অসদাচরণ হিসেবে বিবেচনা করে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান করার সুপারিশের বিষয়ে সব দল একমত পোষণ করেছে। এ ছাড়া স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদানের ক্ষমতা কমানো, জাতীয় আইনগত সহায়তা আইন সংশোধনের বিষয়েও একমত হয়েছে দলগুলো। পাঠানো ২৩ প্রস্তাবের মধ্যে মাত্র ৮ বিষয়ে সব দল একমত হতে পেরেছে। এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট সবিচালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অন্যতম।
অধ্যাদেশের খসড়া প্রস্তুত : পৃথক সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় এরই মধ্যে একটি অধ্যাদেশের খসড়াও প্রস্তুত করা হয়েছে। খসড়াটির ওপর মতামতের জন্য আইন মন্ত্রণালয় থেকে সুপ্রিম কোর্টেও পাঠানো হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট তাদের মতামত দিয়ে অনেক আগেই ফেরত পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়ে।
সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ-২০২৫-এর খসড়ার ৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে একটি সচিবালয় থাকবে এবং এটা সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় নামে অভিহিত হবে। সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় কোনো মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা দপ্তরের আওতাধীন বা নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে না। বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে একজন সচিব এবং অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সমন্বয়ে এ সচিবালয় গঠিত হবে।’ অধ্যাদেশের ৫(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘অন্য কোনো আইন, বিধি বা কার্যবণ্টনে যা কিছুই থাকুক না কেন, দেশের বিচার প্রশাসন পরিচালনায় সুপ্রিম কোর্টকে সহায়তা প্রদান করার জন্য অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সব সাচিবিক দায়িত্ব পালন; সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন সাপেক্ষে রাজস্ব আদালতগুলো ব্যতীত হাই কোর্ট বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন দেশের সব অধস্তন দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত এবং ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা, এখতিয়ার, ক্ষমতা ও গঠন নির্ধারণ; হাই কোর্ট বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন সব আদালত বা ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ ও চাকরির শর্তাবলি নির্ধারণ; সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, শৃঙ্খলা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়; অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, শৃঙ্খলা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় ন্যস্ত থাকবে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের ওপর।’
সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের কার্যপদ্ধতির ব্যাপারে ৬(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রধান বিচারপতির ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং সচিব সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের প্রশাসনিক প্রধান হবেন। ৬(২) সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সচিব সরকারের সিনিয়র সচিবের সমমর্যাদা ও সুবিধাদি ভোগ করবেন।’