Image description

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা সম্প্রতি তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান নিয়ে নিজের মতামত তুলে ধরেছেন। সেখানে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, যে রিকশাওয়ালা নাফিজের মরদেহ টানলেন, তার অবদান কোনো পাল্লায় মাপা যায়?

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের কার কী অবদান, সে প্রসঙ্গে আলোকপাত করতে গিয়ে উমামা ফাতেমা সেখানে বলেছেন, জুলাইয়ের আন্দোলন ছিল একটি সামষ্টিক অভ্যুত্থান, যেখানে ব্যক্তিগত অবদান নয় বরং সমষ্টিগত চেতনা ছিল মুখ্য। কিন্তু ৫ আগস্টের পর থেকে আন্দোলন ব্যক্তিসর্বস্ব হয়ে পড়ে, যেখানে কার কত অবদান—তা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। অথচ আন্দোলনে অনেকেই নীরবে, নিজেদের জায়গা থেকে সর্বোচ্চটা দিয়ে পাশে থেকেছে—যেমন কেউ রক্ত জোগাড় করেছে, কেউ খাবার দিয়েছে, কেউ ফোন রিচার্জ করে সাহায্য করেছে। তাদের অবদানও কম নয়। 

উমামা ফাতেমার পুরো স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হলো।

“জুলাই একটা কালেক্টিভ ঘটনা। অভ্যুত্থানে ব্যক্তি খুব ছোট ফ্যাক্টর। ঐ সময় ব্যক্তিমানুষের সর্বোচ্চ প্রতিদান ছিল সমগ্রের মাঝে বিলীন হয়ে যাওয়া। ৫ আগস্টের আগের অভ্যুত্থান যতটা সামষ্টিক গল্প, ৫ আগস্টের পরের অভ্যুত্থান ততটাই ব্যক্তিসর্বস্ব। যেন কার প্রতিদান কত বেশি ছিল এসবের প্রতিযোগিতা। প্রতিবাদ করতে গেলে, দাবি তুলতে গেলে 'তুমি এতদিন কই ছিলা' শুনতে হয়। পাল্টা জবাব দেয়াটাই ক্লান্তিকর। ধরেন, একটা মানুষ চাকরি করে, তার ২টা বাচ্চা আছে, একটা স্বাভাবিকগতির জীবন আছে। জুলাই এ যখন মুহুর্মুহু গুলি শুরু হয় তখন এই মানুষটা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। একদিকে পরিবার, ২টা বাচ্চা, পার্টনার, বাবা-মা, আরেকদিকে দেশ। মানুষের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করতে না পেরে তিনি পুরো জুলাই মাসে আহতদের জন্য  রক্ত ম্যানেজ করে দিয়েছেন, বিকাশ নাম্বার পেলেই ১০, ২০ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন, বা ধরেন ইন্টারনেট শাটডাউনের সময় সাংবাদিকদের কাছে বিবৃতি ম্যাসেজ পাঠানোর জন্য আমাদের ফোনে রিচার্জ করে দিয়েছেন। যখন যার হেল্প দরকার, পেছন থেকে সাহায্য করলেন। 

আবার ধরেন একজন গৃহিণী, বাসা থেকে রান্না করে মিছিলের মাঝে যিনি খাবার বিতরণ করেছিলেন। ৪ আগস্ট শাহবাগে একটু পর পর শুধু বিস্কিট, সিদ্ধ ডিম, পানি আসছিল। এক আঙ্কেল মিরপুর থেকে বাসায় না জানিয়ে এসেছেন, পানি খাওয়াবেন বলে। ওখানেই হিটস্ট্রোক করলেন, সবাই মাথায় পানি দিল, তার গা মুছে দিল। আঙ্কেল আমাকে প্রটেক্ট করে তার সাথে ফার্মগেট পর্যন্ত নিয়ে আসেন। এরপর ফার্মগেটে গোলাগুলি শুরু হয়। গুলির মাঝে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। আমাদের দেখা হয় অভ্যুত্থানের পর একদিন। আঙ্কেলই আমাকে খুঁজে বের করেছিলেন। আঙ্কেল জানান তিনি গুলির মধ্যে পালাতে গিয়ে ড্রেনে পড়ে যান। আর আমি পেছনের গলিতে ঢুকে পড়ি। কিন্তু ঐ সময় দুইজনের একটা কমন অভিজ্ঞতা হয়, আমরা দেখি রিকশা করে একটা ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছে, ওর মাথা থেকে রক্ত পড়ছে, হাত ঝুলছে। রিকশাওয়ালা সর্বোচ্চ পরিশ্রম করে রিকশা টানছে। ছেলেটার নাম পরে জানতে পারি, নাফিজ। এই মানুষগুলার অবদান কোন পাল্লায় মাপা যায়?

যে মানুষটা ফোনে রিচার্জ করে দিল, যে গৃহিণী খাবার বিতরণ করল, যে আঙ্কেল পানি বিতরণ করলেন তাদের অবদানটা কতটুকু?! তারা তো তাদের সক্ষমতার সবটুকুই করেছে? তাই নয় কি?! তারা যদি আপনার, আমার জায়গায় থাকত তাহলে আমরা যা করেছি তারা তাই করত। 

আমরা বুঝতে চাইনা, আমরা বুঝতে পারি না যে আমরা কেও কারো থেকে কম করিনি। আমরা যার যার অবস্থান থেকে ঐ মুহূর্তের অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছি। হ্যাঁ, অনেকে ছিল, আমি দেখেছি ঐ সময়গুলোতে, সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও চুপ করে থেকেছে, ৫ আগস্টের পর বাঘের গর্জন করছে। কিন্তু ঐ হিসাব আলাদা। কিন্তু যে জনগণ তার সকল হিসাব নিকাশের বাইরে লড়াই এ শামিল হয়েছে সেখানে অবদানের প্রশ্ন কোথা থেকে আসে?

লড়াইয়ের সময় আসলে অবদানের প্রশ্ন গৌণ। অবদানের প্রশ্ন তখনই আসে যখন রাজনৈতিক ফায়দার প্রশ্ন আসে। আপনি যদি অভ্যুত্থানে নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে লড়াই করেন, কিন্তু কোনোভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কাতারে পড়েন তাহলে ধরে নিতে হবে আপনি আন্দোলনই করেননি। ক্ষমতার সাথে আন্দোলনে অবদানের সম্পর্ক সমানুপাতিক। যে ক্ষমতার যত কাছাকাছি সে আন্দোলনে তত ত্যাগী। তাই পরবর্তী অভ্যুত্থানে আন্দোলনে নামার আগেভাগেই ক্ষমতা থেকে আন্দোলনে অবদানের সার্টিফিকেট নেয়াই শ্রেয়।”