Image description

বাংলাদেশের রাজনীতি দুটি পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে—এটা হতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সংসদ সদস্য রূপা হক। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ডাক্তার, হসপিটাল থেকে শুরু করে প্রতিটি স্তরেই আওয়ামী লীগের মানুষ বসে আছে। এসব প্রতিষ্ঠান পরিষ্কার করতে হবে, তাঁদের সরাতে হবে। তারপর নির্বাচন দিতে হবে। অন্যথায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। যদি আমরা এক পার্টিকে আরেক পার্টি দিয়ে সিস্টেম রিপ্লেস করি, তবে এটা ভালো না।’

একজন নেতার কন্যা, আরেকজন নেতার বেগম এবং তাঁদের ছেলেরা সবকিছুতে আধিপত্য দেখাবে—এ প্রবণতার পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রায় ৫৪ বছরের এ বাস্তবতা থেকে বের হয়ে আসতে একটা পরিচ্ছন্নতা অভিযান দরকার। লেজিসলেশন করে (আইন প্রণয়ন) নতুন কিছু করার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছেন তিনি।

আজ মঙ্গলবার ঢাকা সফররত ইউকে বাংলাদেশ ক্যাটালিস্টস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ইউকেবিসিসিআই) প্রতিনিধিদলের সম্মানে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন রূপা হক।

বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ রাজধানীর হোটেল সেরিনায় এই আয়োজন করে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এতে প্রধান অতিথি ছিলেন। সভাপতিত্ব করেন বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল।

এ সময় তিনি বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক আরও জোরদার করতে ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট বা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতিকাঠামোর আওতায় এফটিএ হলে বাংলাদেশ লাভবান হবে। মার্ক অ্যান্ড স্পেনসারের মতো ব্রিটিশ ব্র্যান্ড এ দেশের তৈরি পোশাকের বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত। শুধু পোশাক খাতের ওপর রপ্তানি নির্ভর করলে চলবে না, নানা প্রযুক্তি, বিশেষ করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। মেইড ইন বাংলাদেশকে আরও সম্প্রসারণের পরামর্শ দেন তিনি। তিনি বলেন, মুনাফাই ব্যবসার শেষ কথা নয়। শ্রম অধিকারেও গুরুত্ব দিতে হবে। শ্রমিক অধিকার নিয়ে বিগত সরকারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর অনেক টানাপোড়েন ছিল। তবে ড. ইউনূস এ বাস্তবতা বদলাতে চান।’

রূপা হক আরও বলেন, শুধু পোশাক খাতের ওপর রপ্তানি নির্ভর করলে চলবে না, নানা প্রযুক্তি, বিশেষ করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ রয়েছে আমাদের। শ্রমিক অধিকার নিয়ে বিগত সরকারের সঙ্গে আইএলওর অনেক টানাপোড়েন হয়েছে। তবে ড. ইউনূসের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, তিনি এখনকার বাস্তবতা বদলাতে চান। এই তাগিদটা ধরে রাখতে হবে।

তিনি আরও বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে যুক্তরাজ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে; বিশেষ করে তেল, গ্যাস ও গমের মতো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনে চরম চাপ ফেলছে। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে বাণিজ্যের নতুন পথ খুঁজতে হবে।

ইউকেবিসিসিআই চেয়ারম্যান ইকবাল আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের ভালো পরিবেশ রয়েছে। তবে এটি আরও ভালো করতে হবে। এখন পর্যন্ত নতুন বিনিয়োগকারীকে কোনো উদ্যোগ শুরু করতে ১২টি অফিসের লাইসেন্স নিতে হয়। সুতরাং এখানকার ডুয়িং বিজনেস কোস্ট কমাতে হবে।

তিনি বলেন, ‘যুক্তরাজ্যের বাজারে সেবা খাতে নম্বর ওয়ান এখন ভারত। আমরা পারছি না; কারণ, একটি হলো, আমি যে অনুষ্ঠান বা ফোরামেই যাই, তারা শুধু আমাকে প্রশ্ন করে, বাংলাদেশে এত সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে কেন।’

বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন।

আমীর খসরু মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। সাধারণের মানসিক পরিবর্তন আনতে হবে। আমি বারবার বলছি, সিস্টেমকে স্বচ্ছ করতে হবে। পলিটিশিয়ান বেটার ওয়েক আপ অ্যান্ড স্মেল দ্য কফি। যদি সিস্টেম স্বচ্ছ, নির্বাচন পদ্ধতি ঠিক থাকে। তবে কার বউ নির্বাচনে এল, কার ছেলে আসল, এটা তো ব্যাপার না। তারা নির্বাচিত হয়েই আসবে।’

রুপা হকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় এ নেতা বলেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে বলে অপপ্রচার চলছে; যা একেবারেই সত্য নয়। বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। প্রতিবেশী কিংবা অন্য অঞ্চলে যা-ই হোক, বাংলাদেশে হয়রানির কোনো ঘটনা ঘটছে না। এ ধরনের অপপ্রচার বন্ধে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যাতে ভূমিকা রাখেন, এ ব্যাপারে রুপা হকের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।

আমীর খসরু বলেন, বিগত সরকার গত ১৫ বছরে অর্থনীতিকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ধ্বংস করা হয়েছে। ব্যাংক, বিমা থেকে টেলিকম—সবকিছুই তারা নিয়ন্ত্রণ করত। সাধারণ ব্যবসায়ী বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশার সুযোগ রাখা হয়নি। অলিগার্কির (কিছু লোকের হাতে সব ক্ষমতা, কর্তৃত্ব কেন্দ্রীভূত করে রাখা) অর্থনীতি কায়েম ছিল। ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়ার পর বাঁচার জন্য একে একে সব স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়।

আমীর খসরু আরও বলেন, ‘সেই অধ্যায় শেষ হয়েছে। নতুন বাংলাদেশ নিয়ে দেশে-বিদেশে আশার দুয়ার খুলেছে। ব্যবসা ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে লেভেল প্লেয়িং (সুযোগের সমতা) সৃষ্টি করা হবে। এ বিষয়ে তাঁরা হোমওয়ার্ক অর্থাৎ, নিজেদের মধ্যে আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা—সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা জানার চেষ্টা করছেন। আমীর খসরু মাহমুদ বলেন, ‘আপনাদের কথা দিচ্ছি, আমরা অর্থনীতিকে উদার, গণতান্ত্রিক করব। সবাই সমান সুযোগ-সুবিধা পাবেন।’

অর্থনীতির গণতন্ত্রায়ণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে আমীর খসরু বলেন, ‘বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমাদের আরও উদার হতে হবে। সমস্ত বড় সুযোগ-সুবিধা কেন শুধু পোশাক খাত পেল, আর অন্য ২০টি সম্ভাবনাময় খাত তা পেল না, সেটি গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে। সবার জন্য সমান সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে ব্যবসার খরচও স্বাভাবিক নিয়মেই কমে আসবে।

আমীর খসরু আরও বলেন, ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু এত বড় তরুণ কর্মী বাহিনী যদি দক্ষ না হয়, তাহলে এই জনসংখ্যার সুবিধা কোনো কাজে আসবে না। সবার জন্য সমান সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে কস্ট অব ডুইং বিজনেস নিজস্ব গতিতে কমে যাবে।’

আমীর খসরু বলেন, ‘যখন আমরা ক্ষমতায় আসব, আমাদের কূটনীতি হবে বাণিজ্যকেন্দ্রিক। প্রতিটি মিশনকে বাণিজ্য প্রসার এবং প্রবাসীদের সঙ্গে সঠিক সম্পৃক্ততা নিয়ে তাদের অগ্রগতির প্রতিবেদন দিতে হবে।’

বিজিএমইএর প্রশাসক মো. আনোয়ার হোসেন জানান, বাংলাদেশ এখনো বছরে ১১ বিলিয়ন ডলারের টেক্সটাইল পণ্য আমদানি করে, যা কমিয়ে আনার জন্য এই খাতে বিনিয়োগের সুযোগ কাজে লাগানো উচিত। ভিয়েতনামের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ভিয়েতনামের আদলে বর্তমান সরকার যদি যুক্তরাজ্যের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার উদ্যোগ নেয়, তাহলে রপ্তানি অনেক বাড়ানো সম্ভব। এ ছাড়া প্রযুক্তি ও গবেষণা খাতেও একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ আছে।

বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বিদেশি ক্রেতারা অন্যায্যভাবে কম দামে পোশাক কিনছে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন আরও তিন বছর পিছিয়ে দিলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতির হাত থেকে কিছুটা রক্ষা পেতে পারেন।

ইউকেবিসিসিআই সভাপতি বলেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন করে ৫০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ করবেন তাঁরা। এত দিন কেন এ বিনিয়োগ করা হয়নি, সে ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, গত ১৫ বছর বাংলাদেশে তাঁরা আসতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশনকে রাজনৈতিক নয়, বরং ব্যবসায়িক উন্নয়ন হাউস হিসেবে কাজ করতে হবে। সংখ্যালঘু নির্যাতনের অপপ্রচার বন্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে।