Image description

রাজধানী ঢাকার ৬৩ শতাংশ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (বিদ্যালয়) নেই যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নির্ধারিত কমিটি। ১৬ বছর আগে দেয়া এ বিষয়ে আদালতের নির্দেশ মানছে না অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এমনকি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) বিধি বিধানও আমলে নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষগুলো। অথচ বিভিন্ন গবেষণা বলছে, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা বেশি যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে।

২০২৩ এর আগস্টে ৯ম শ্রেণির শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে রাজধানী ঢাকার একটি স্বনামধন্য স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক ইংরেজির শিক্ষকের বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানটির বসুন্ধরা শাখার শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে লাগাতার আন্দোলনে নামে। ভুক্তোভোগী শিক্ষার্থীর বাবার করা আবেদনের প্রেক্ষিতে তদন্তের নির্দেশ দেন খোদ ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার। বিভাগীয় সেই তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে, স্কুল থেকে বরখাস্ত হন ইংরেজির শিক্ষক আবু সুফিয়ান। অথচ এই ঘটনা যখন ঘটে, তার ১৪ বছর আগে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ সেল গঠন করার নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। কিন্তু সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন কোনো ব্যবস্থা কার্যকর না থাকায় ভুক্তভোগী অভিভাবক বাধ্য হন বিভাগীয় কমিশনারের কাছে অভিযোগ জানাতে।

এর পরের বছরই সেই স্কুল অ্যান্ড কলেজের আজিমপুর শাখার শিক্ষক মুরাদ হোসেনকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বদলী করা হয় বেইলি রোডের মূল শাখায়। তার বিরুদ্ধেও ছিল একই অভিযোগ। পরে তাদের বিষয়ে বিভাগীয় কোনও শাস্তি হয়েছে কিনা জানেন না শিক্ষার্থীরা। অথচ যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ নীতিমালা-২০১০ অনুযায়ী, অপরাধের মাত্রা অনুসারে অভিযুক্ত (শিক্ষক ও কর্মচারী) ব্যক্তিকে চাকরিচ্যুত অথবা প্রশাসনিক কাজ থেকে বিরত রাখা ও অর্থদণ্ড দেয়ার বিধান আছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা।


 যৌন নিপীড়ন প্রতিবাদ। ফাইল ছবি
২০০৯ সালে বাংলাদেশ হাইকোর্ট দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয়। নারী সদস্যের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের সেই কমিটি বছরে দুটি বৈঠক করবে। কমিটি অভিযোগ কেন্দ্র পরিচালনা করবে। প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ারও সুপারিশ করার এখতিয়ার রাখবে। এরপর, ১৩ বছরেও নির্দশনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো না মানায়, ২০২২ এ মাউশি অধিদপ্তর বিভাগীয় নির্দেশ দেয়- সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন কমিটি থাকা বাধ্যতামূলক। কমিটি না থাকলে বিধিগত ব্যবস্থা নেবে অধিদফতর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, এসব নির্দশনা অধিকাংশ ক্ষেত্রই স্রেফ ফাইলবন্দি হয়েই রয়ে গেছে বছরের পর বছর।

ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসের ২০২৪ সালের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর রেজিষ্ট্রার্ড এক হাজার ১৩২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ৪১৭টিতে যৌন নিপীড়নবিরোধী কমিটি আছে। অর্থাৎ ৬৩ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হাইকোর্টের নির্দেশনা কার্যকর করেনি। দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের এ নিয়ে সরেজমিন অনুসন্ধানে উঠে আসে উদ্বেগজনক এক চিত্র। গত মাসের ১৯, ২২ ও ২৩ জুন শিক্ষা কার্যক্রম চলাকালীন সময়ে ঢাকার কয়েকটি স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরেজমিনে যান এই প্রতিবেদক। 

এ বিষয়ে সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শাবুদ্দিন মোল্লা বলেন, এ বিষয়ক কমিটি আমাদের আছে। কয়েকমাস আগেই আমরা এর একটি বৈঠক করি। তবে আমাদের কাছে এখনও পর্যন্ত কোনো অভিযোগ আসেনি। তবে কমিটি আছে জানিয়ে মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘শেষ কবে বৈঠক হয়েছে, বলতে পারছি না। কারণ, অভিযোগ কখনো আসেনি।’

‘‘স্কুলগুলোতে কমিটি না থাকা বা নিষ্ক্রিয় থাকা সরাসরি হাইকোর্টের নির্দেশনা লঙ্ঘনের শামিল। এই অবহেলার দায় প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নিতে হবে। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নয় অনেক জায়গায়ই নামেমাত্র বা একেবারেই এই নিয়মগুলো মানছে না- এ সবই আদালত অবমাননা তো বটেই শাস্তিযোগ্য অপরাধও। এছাড়া, এই অবহেলার কারণে, অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে একশ্রেণির অপরাধীদের অন্যদিকে অপরাধকে মেনে নিতে স্কুল থেকেই শিখছে শিক্ষার্থীরা-শাহিনুজ্জামান, আইনজীবী, আইন ও সালিশ কেন্দ্র

রামপুরার একরামুন্নেসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, কমিটি ছিল, এখন সচল কি না বলতে পারছি না। অপরদিকে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জামিল উদ্দিন বলেন, কমিটিতে অভিযোগ আসেনি, মাঝে মাঝে বসা হয় কি না নিশ্চিত না।

শাস্তির ভয়ে কিছু কর্তৃপক্ষ কমিটি করেছেন ঠিকই, তবে তা নামেমাত্র। অভিযোগ আসুক বা না আসুক কমিটির বৈঠক করতে হবে বছরে অন্তত ২ বার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকতে হবে অভিযোগ সেল। কিন্তু সরেজমিনে গিয়ে কমিটি আছে এমন প্রতিষ্ঠানে এর কিছুই নজরে আসেনি। তবে সব কর্তৃপক্ষেরই আছে খোড়া যুক্ত-অভিযোগ আসে না তাই বৈঠক হয় না। অভিযোগ সেলও কাজ করছে না। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভিভাবদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতে চাইলে অধিকাংশই শিক্ষার্থীদের নিরাপদ শিক্ষা জীবনের ক্ষতির কথা বলে এড়িয়ে যান।


 যৌন নিপীড়ন প্রতিবাদ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধা। ফাইল ছবি


নাম-পরিচয় গোপর রাখার শর্তে কয়েকজন নারী অভিভাবক জানান, বড় মাত্রার নির্যাতন না ঘটলেও হয়রানির নানা ঘটনা ঘটে। কিন্তু এ নিয়ে কথা উঠলে বাচ্চাদের উপর হেনস্তা বা স্কুল থেকে বের করে দেয় যদি, তাই চুপ থাকি আমরা। আর শিক্ষকরা সবাই তাদের কোনো স্বার্থে লাগলে এক হয়ে যায়। গভর্নিং বডি বা কমিটিও অভিভাবকের পাত্তা দেয় না। প্রশ্ন হচ্ছে, গণমাধ্যমেই কথা বলতে নারাজ অভিভাবক বা শিক্ষার্থীরা প্রকাশ্যে কীভাবে অভিযোগ করবে শিক্ষক বা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে? 

এ বিষয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের এক অভিভাবক দিলারা আক্তার বলেন, কমিটির কথা জানি না। কিন্তু এমন কিছু থাকলে মেয়েরা অন্তত একটা ভরসার জায়গা পাবে। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের এক অভিভাবক তানজিনা বলেন, এই স্কুলে অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। বিদ্যালয়ের প্রশাসন এ বিষয়গুলো জেনেও কেন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে না আমি জানি না। আমি দাবি করব কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই যেন এ ধরণের শিক্ষকগুলোকে আশ্রয় না দেওয়া হয়।

এমন কমিটির বিষয়ে এ সবকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের উত্তরও ছিল একই-এরা কেউই এমন কোনও কমিটি সম্পর্কে জানে না। এমনকি স্কুল কর্তৃপক্ষ বা শিক্ষকদের পক্ষেও নিয়ে কখনও কিছু জানানো হয়নি।

২০২৩ সালের নভেম্বরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রকাশ করা এক জরিপ প্রতিবেদনে জানা যায়, জরিপে অংশ নেওয়া শিশুদের ৪৫.৩% কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। অপরাধী প্রায়শই পরিচিত-কেউ শিক্ষক, আত্মীয়, প্রতিবেশী। ভিকটিমদের মধ্যে দেখা গেছে PTSD, বিষণ্ণতা, আত্মঘাতী প্রবণতা, স্কুলবিমুখতা। অধিকাংশ পরিবার বিচারপ্রক্রিয়ায় প্রবেশই করতে চায় না পুলিশি অনীহা, প্রমাণ সংকট, সামাজিক হেনস্তার আর দীর্ঘসূত্রতার ভয়ে। এর মূল কারণ।

এ বিষয়ে দীর্ঘদিন মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র সংস্থা। এটির আইনজীবী শাহিনুজ্জামান বলেন, স্কুলগুলোতে কমিটি না থাকা বা নিষ্ক্রিয় থাকা সরাসরি হাইকোর্টের নির্দেশনা লঙ্ঘনের শামিল। এই অবহেলার দায় প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নিতে হবে। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নয় অনেক জায়গায়ই নামেমাত্র বা একেবারেই এই নিয়মগুলো মানছে না- এ সবই আদালত অবমাননা তো বটেই শাস্তিযোগ্য অপরাধও। এছাড়া, এই অবহেলার কারণে, অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে একশ্রেণির অপরাধীদের অন্যদিকে অপরাধকে মেনে নিতে স্কুল থেকেই শিখছে শিক্ষার্থীরা।

এ বিষয়ে মাউশি অধিদফতের ওয়েবসাইটে শুধু একটি তথ্যই পাওয়া যায়, ২০২২ সালে দেয়া নির্দেশনার কপি। তবে সে নির্দেশনা কারা, কতটা কীভাবে মানছে এই নিয়ে সেখানে কোনও তথ্য নেই। আর এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে বারবার কথা চেষ্টা করেও সদুত্তর মেলেনি।