
সরকারের ভেতরে সরকার। এই শিরোনামে লিখতে হবে ভাবিনি। বিশেষ করে প্রফেসর ইউনূসের সরকারকে নিয়ে। কারণ প্রফেসর ইউনূসের ছিল আকাশসম জনপ্রিয়তা, দেশে-বিদেশে। কিন্তু সব ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। এগারো মাস আগে এক রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউনূসের সরকার। প্রেক্ষাপট সবার জানা। অভ্যুত্থানকালে তিনি দেশে ছিলেন না। বিদেশে বসেই তিনি শুনতে পান হাসিনা আউট। অন্তহীন খুশিতে তিনি তখন টগবগ করছিলেন।
দেশে ফিরলেই যেখানে তাকে জেলে যেতে হতো তার বদলে হয়তো অন্য কিছু অপেক্ষা করছে। যাই হোক প্রথমে বিশ্বাস করেন নি। পরে তার কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয় দেশি-বিদেশি টেলিফোন পাওয়ার পর। যদিও সমালোচকরা বলছেন, ঢাকায় কী ঘটছে তা তিনি জানতেন আগেভাগেই। একটি নীলনকশার মাধ্যমে এই পরিবর্তন আসে। এখন দিন দিন পরিষ্কার হচ্ছে কী ছিল সেই নীলনকশায়। কারা ছিলেন এর সঙ্গে যুক্ত। যাই হোক, ছাত্রদের বিরামহীন প্রচেষ্টার পর প্রফেসর ইউনূস রাজি হন। অনিশ্চয়তা কেটে যায়। ৮ই আগস্ট ২০২৪। প্যারিস থেকে উড়ে এসে দায়িত্ব নেন সরকারের। তখন সবার প্রত্যাশা ছিল চমকপ্রদ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তা কি আর হয়! শুরুতেই হোঁচট। ‘গ্রামীণ বক্স’-এর মধ্যে ঢুকিয়ে দেন সরকারকে। পুরনো সহকর্মী পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত হয় সরকার।
এক দুর্বল উপদেষ্টা পরিষদ দেখে দেশবাসী তখন হতাশ এবং ক্ষুব্ধ। ছাত্ররা যেখানে মানসিকভাবে সরকারে যেতে প্রস্তুত ছিল না সেখানে তাদের জায়গা দেন এক অবিশ্বাস্য চালে। আর এখানেই করলেন ভুল। এখন তিনি হিসাব মেলাচ্ছেন আর বলছেন, তাড়াহুড়ো করে সরকার গঠন না করে আরও সময় নেয়া যেত। ভুল পরামর্শ যারা দিয়েছিলেন তারা এখন আখের গুছিয়ে ইউনূসের সমালোচনা করছেন আড়ালে-আবডালে, কখনো চায়ের টেবিলে।
বিপ্লবের পর তিউনিশিয়া পেয়েছিল এক দুর্বল গণতন্ত্র। বাংলাদেশ পেলো এক দুর্বল সরকার। একের পর এক চ্যালেঞ্জ আসতে থাকলো। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনে কাবু ছিল রাজনীতি, প্রশাসন। ব্যক্তির কথায় চলতো গোটা প্রশাসন। গুম-খুন ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। ছিল না গণতন্ত্র। মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিল। টাকা লুট ছিল নেশা, বিদেশ পাচার করায় ছিল তীব্র প্রতিযোগিতা। দেশটা হয়ে গিয়েছিল ফোকলা। এর মধ্যেই প্রফেসর ইউনূস দায়িত্ব নেন। যেখানে হাত দেন সেখানেই শুধু নেই আর নেই। ভেঙে পড়লো প্রশাসন। বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসন। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করাই ছিল তার প্রথম চ্যালেঞ্জ। এখনো তিনি লড়াই করছেন সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়।
১৭৭ জন মানুষ ‘মব সন্ত্রাসের’ শিকার হলো। সরকারের অনেক সিদ্ধান্ত বাতিলে মব সন্ত্রাস হয়ে গেল এক ধরনের হাতিয়ার। ইউনূস দেখেও না দেখার ভান করলেন। কারণ এরাই তার নিয়োগকর্তা এবং কাছের লোক। পুলিশের মনোবল চাঙ্গা করতে নেয়া হলো অনেকগুলো কৌশল। ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বারবার থেমে গেল সব প্রচেষ্টা। কারণ পুলিশে ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ। হাসিনা চলে গেলেও তার প্রশাসন ছিল সচল। ঢালাও খুনের মামলা পরিণত হলো টাকা বানানোর কৌশলে। মানুষ বিরক্ত হলো। ভিন্নরূপে আইনি শাসন ধাক্কা খেলো। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যখন আইনের দায়িত্ব নেন তখন সবার ধারণা ছিল এবার আইন চলবে নির্মোহভাবে। অল্পদিনের মধ্যেই সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। হেঁটে হেঁটে তিনি আইন পরিবর্তন করতে থাকলেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এসবের উপর নজর রাখছে। তারা বলছে, ময়লার মধ্যে আটকে যাচ্ছেন এই শিক্ষক। অবশ্য তার ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, ওসব বাজে কথা। তার ইমেজ নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। এই নিয়ে যখন কানাঘুষা এবং বিতর্ক চলছিল তখনই প্রফেসর ইউনূসের বিশ্বাসে কিছুটা হলেও চিড় ধরলো। এখন অনেক দূরত্ব। আইন যেখানে অসহায় তখন মানুষ কী করবে। মানুষ কার উপর ভরসা রাখবে। মন্ত্রণালয় সামলাতে প্রফেসর ইউনূস বেছে নিলেন এক অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাকে। সেনা কাম নির্বাচন বিশেষজ্ঞ এই কর্মকর্তা দায়িত্ব পেয়ে শুরুতেই ভুল করে বসলেন। তাকে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে সরিয়ে দেয়া হলো। এটাও যে ভুল ছিল আখেরে তাই প্রমাণিত হয়েছে। এরপর যাকে বেছে নেয়া হলো তিনিও একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। কথাবার্তা, চালচলনে খুবই সাদাসিধে। সহজ সরল এই মানুষটির পক্ষে এই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় চালানো যে কঠিন তা তিনি পদে পদে প্রমাণ করছেন। আশার কথা- তার গায়ে কোনো ময়লা লাগেনি। তার কাছে কৃষি মন্ত্রণালয় জুড়ে দেয়াটাও ছিল আরেক ভুল সিদ্ধান্ত।
উপদেষ্টা পরিষদ গোড়া থেকেই নির্বাচন প্রশ্নে বিভক্ত। একদল নির্বাচনের পক্ষে। অন্যদল মনে করে এখনই নির্বাচন কেন? নির্বাচনবিরোধী স্রোতটাই প্রবল। এই স্রোতটি কৌশলে ছাত্রদের সঙ্গে হাত মেলায়। তারা বলছে, জাতীয় নাগরিক পার্টি ঘুরে না দাঁড়ানো পর্যন্ত নির্বাচন দেয়া কি ঠিক হবে! তারাই কিন্তু ঐকমত্য কমিশন গঠনের প্রস্তাব রেখেছিল। তাদের যুক্তি ছিল- বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পারবে না। তখন নির্বাচনের দাবি অযৌক্তিক প্রমাণিত হবে। তাদের এসব অনৈক্যের বয়ান জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। আমরা তখন বলতে পারবো আপনারাই তো একমত নন। এই অবস্থায় নির্বাচন হয় কীভাবে! এসব লক্ষ্য নিয়েই টেলিভিশনে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা সরাসরি সমপ্রচার করার সিদ্ধান্ত হয়। উপদেষ্টারা নতুন নতুন তত্ত্ব হাজির করছেন পর্দার আড়ালে থেকে বিশ্বস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে। আইনজীবী আর আমলানির্ভর এই স্রোত নির্বাচনকে বারবার অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। জুলাই সনদ নিয়েও নানা খেলা রয়েছে।
লন্ডন বৈঠকের পরও ষড়যন্ত্র থেমে নেই। আর এই ষড়যন্ত্র হচ্ছে ইউনূসের সরকারের ভেতর থেকেই। এই সুযোগ নিচ্ছে উগ্রবাদীরা। তারা ক্ষমতা দখলের চেষ্টায় বিভোর। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরা সবাই ইউনূসের পছন্দের লোক। ব্যক্তিপূজার কৌশলে তারা নিজস্ব চিন্তা-চেতনা বাস্তবায়ন করতে সক্রিয়। মাঝে মধ্যে প্রফেসর ইউনূস যে পুলকিত হন না- তা কিন্তু নয়। সর্বশেষ প্রফেসর ইউনূস কিছুটা বুঝতে পেরেছেন। তাই ডানা কেটে দিচ্ছেন। বলছেন ব্যক্তিপূজা নয়, তোমাদের মতলব সম্পর্কে আমি বুঝতে পেরেছি। অনেক হয়েছে, এখন আমার এত প্রচারের দরকার নেই। এসব করতে থাকলে দেশ এক অনিশ্চয়তার মধ্যে ডুবে যাবে। আমাকেই জনগণ কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। আমার পুঁজি-পাট্টা সবই যাবে। কে জানে আমার সামনে কী অপেক্ষা করছে! কয়েকজন উপদেষ্টাকে সতর্ক করেছেন তিনি। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, প্রফেসর ইউনূস গোয়েন্দা তথ্যের উপর আগাগোড়াই আস্থাশীল নন। তিনি চলেন তার মতো। গোয়েন্দাদের ব্যাপারে তার ধারণা মোটেই সুখকর নয়। প্রায়ই বলেন, ওরা শোনা কথা আর প্রচার মাধ্যমের খবরের উপর নির্ভরশীল। বঙ্গবন্ধু অতিমাত্রায় বিশ্বাস রাখতেন আমলাদের ওপর। হাসিনারও এই বাতিক ছিল।
ইউনূস কি এসব থেকে মুক্ত? জানা গেল তিনিও আমলানির্ভর হয়ে পড়ছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, হাসিনার বিশ্বস্তদের হাতেই ইউনূস সরকারের চাবিকাঠি। এটা শুধু বেসামরিক প্রশাসন নয়। এর ফলে ইউনূসের জনপ্রিয়তা দিন দিন কমছে। একের পর এক ভুল করে যাচ্ছেন তিনি। নির্বাচন নিয়ে স্থির থাকতে পারছেন না। বিদেশিরা একসময় বলতেন, ইউনূস ছাড়া বাংলাদেশে এই মুহূর্তে কোনো বিকল্প নেই। এখন তারা বলছেন, কোথায় যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ নিয়ে বিদেশি শক্তি এখন সমালোচনামুখর। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে ইউরোপ থেকেও অন্য বার্তা পাচ্ছেন প্রফেসর ইউনূস। পশ্চিমা গণমাধ্যমের সুরও পাল্টে যাচ্ছে। সরকারের ভেতরে আরেকটি সরকার থাকলে পরিণতি কী হয় অতীতে আমরা দেখেছি বাংলাদেশে। সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। প্রফেসর ইউনূসকে এটা বুঝতে হবে- এই উপদেষ্টা পরিষদ দিয়ে সামনের চ্যালেঞ্জিং নির্বাচনকে সামাল দেয়া সম্ভব নয়। যারা কিনা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষেই বন্দি। ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি সম্পর্কে তারা মোটেই ওয়াকিবহাল নন। এই অবস্থায় নীতিকৌশল তারা কীভাবে ঠিক করবেন। এখানে বলে রাখা ভালো, ঘুষ-দুর্নীতি আরও বেড়েছে। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে বাজার পরিস্থিতি সহনীয়। কৃষক ন্যায্যমূল্য না পেলেও সাধারণ ভোক্তারা ঠিকই এর সুবিধা পাচ্ছেন। সরকার অনেক ভালো কাজও করেছে। বিশেষ করে সংস্কার পর্বে বেশ কিছু অগ্রগতি হয়েছে। উপদেষ্টারা সরকারি এসব সাফল্য জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে পারছেন না। নীতিনির্ধারকদের কারও কারও ব্যাপারেও নানা অভিযোগ উঠছে। কমিশন বাণিজ্য প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। ব্যবসায়ীরা হতাশ। নেই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ। জনগণ বড়ই চিন্তিত। দেশটা কি গণতন্ত্রের পথে হাঁটবে? নাকি এক অজানা গন্তব্যই হবে নিয়তি!
(জনতার চোখ থেকে)