
৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুলে পুলিশের গুলিতে শিক্ষার্থী শাহরিয়ার খান আনাসসহ ৬ আন্দোলনকারীর শাহাদাতবরণের ঘটনায় চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে অভিযোগপত্রে। জানা গেছে, সেদিন তৎকালীন রমনা জোনের এসি মোহাম্মদ ইমরুলের ইশারায় কনস্টেবল ইমাজ হোসেন ইমন গুলি চালালে আনাস ঘটনাস্থলেই নিহত হন। তার বুকে দুটি ও মাথায় একটি গুলি বিদ্ধ হয়েছিল।
বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) এই মামলার চার আসামির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চেয়ে করা পৃথক আবেদনের ওপর শুনানি হয়। শুনানি শেষে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশের জন্য ১৪ জুলাই দিন ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
জানা গেছে, সেদিন ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি প্রতিহত করতে চানখাঁরপুল এলাকায় ব্যারিকেড দেয় পুলিশ। এ সময় গলির মুখে দায়িত্বরত রমনা জোনের তৎকালীন এসি মোহাম্মদ ইমরুল কনস্টেবল ইমাজ হোসেন ইমনকে ইশারায় শিক্ষার্থী আনাসকে দেখিয়ে গুলি করতে বলেন। কথামতো ইমন মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে চাইনিজ রাইফেল দিয়ে গুলি ছুড়লে আনাস ঘটনাস্থলেই শাহাদতবরণ করেন। তার বুকে ২টি ও মাথায় ১টি গুলি বিদ্ধ হয়েছিল।
বৃহস্পতিবার এ মামলার চার আসামির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চেয়ে (ডিসচার্জ) করা পৃথক আবেদনের ওপর উভয়পক্ষের শুনানি হয়। শুনানি শেষে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশের জন্য ১৪ জুলাই দিন ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ এ আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন-বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। আনাসের পরিবার সূত্র জানায়, আনাস সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল করে পড়ার টেবিলের ওপর মাকে উদ্দেশ করে একটি চিঠি লিখে বেরিয়ে যায়। আনাসের মা সকালের নাশতা আনতে ছোট ছেলেকে পাঠান আনাসকে ডাকতে। সে এসে বলে, ভাইয়া ঘরে নেই। আনাসের মা সানজিদা খান দীপ্তি তৎক্ষণাৎ ছুটে যান আনাসের রুমে। ঘর খালি, হঠাৎ চোখে পড়ে আনাসের পড়ার টেবিলে থাকা একটি চিঠি। চিঠিতে আনাস লিখেছে, ‘মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি। আমি নিজেকে আর আটকিয়ে রাখতে পারলাম না। সরি আব্বুজান। তোমার কথা অমান্য করে বের হলাম। স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে থাকতে পারলাম না। আমাদের ভাইরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে রাজপথে নেমে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। অকাতরে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিচ্ছে। একটি প্রতিবন্ধী কিশোর, ৭ বছরের বাচ্চা, ল্যাংড়া মানুষ যদি সংগ্রামে নামতে পারে, তাহলে আমি কেন বসে থাকব ঘরে। একদিন তো মরতে হবেই। তাই মৃত্যুভয় করে স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে না থেকে সংগ্রামে নেমে গুলি খেয়ে বীরের মতো মৃত্যু অধিক শ্রেষ্ঠ। যে অন্যের জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেয় সে-ই প্রকৃত মানুষ। আমি যদি বেঁচে না ফিরি, তবে কষ্ট না পেয়ে গর্বিত হয়ো। জীবনের প্রতিটি ভুলের জন্য ক্ষমা চাই।’ মৃত্যুর পর তার লেখা চিঠিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় এবং হত্যাকারীর বিচারের দাবিতে সারা দেশে মানুষ ফুঁসে ওঠে।
শনিবার আনাসের বাবা শাহরিয়ার খান পলাশের সঙ্গে কথা হয়। তিনি যুগান্তরকে বলেন, সেই চিঠি পড়ে বুঝতে পারলাম আমার আনাস যুদ্ধে গেছে। আনাসের সঙ্গে রাতেই কথা হয়েছিল, আমরা সবাই একসঙ্গে যাব। কিন্তু আনাস একাই বেরিয়ে পড়ে। মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল। কারফিউ চলছে, চারপাশে গোলাগুলির শব্দ। খোঁজ পাচ্ছিলাম না আনাসের। পরে মিটফোর্ড হাসপাতালে আনাসের লাশ পাওয়া যায়। এমন শত শত হত্যাকাণ্ডের জন্য খুনি হাসিনাসহ দায়ীদের প্রকাশ্যে ফাঁসি চাই আমি। ট্রাইব্যুনালের প্রতি আস্থা এবং বিশ্বাস আছে। আশাকরি ন্যায়বিচার পাব। তিনি বলেন, আনাসের নামে নামকরণ করা হয়েছে গেণ্ডারিয়ার একটি সড়ক। সোমবার (কাল) উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সেই সড়কের উদ্বোধন করবেন।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, আন্দোলন দমন করতে ব্যবহার করা হয় আগ্নেয়াস্ত্র, এপিসি কার, হেলিকপ্টার, ড্রোন ও বিপুল পরিমাণ বুলেট। পুলিশের গুলিতে নিহত হন আনাস, শেখ মাহদী হাসান জুনায়েদ, মো. ইয়াকুব, মো. রাকিব হাওলাদার, মো. ইসমামুল হক ও মানিক মিয়া শাহরিক। পলাতক আসামি হাবিবুর রহমানসহ অন্য অভিযুক্তরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এবং অধীনস্থদের গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। তাদের সহযোগিতা ও নির্দেশেই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।
এ মামলায় আট আসামির মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ্ আলম মো. আখতারুল ইসলাম ও রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল পলাতক আছেন। মামলার অপর চার আসামি গ্রেফতার হয়েছেন। তারা হলেন-শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক মো. আরশাদ হোসেন, সাবেক কনস্টেবল মো. সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ও মো. নাসিরুল ইসলাম। ২৯ জুন আট আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের আবেদন ট্রাইব্যুনালে জানিয়েছিল প্রসিকিউশন। ২৫ মে ট্রাইব্যুনালে এই মামলার ফরমাল চার্জ দাখিল করে প্রসিকিউশন। সেদিনই এই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।