Image description

একজন মাকে হারিয়েছে অপরজন হারিয়েছেন মেয়েকে। বিধাতা যেন দুজনকে এক সঙ্গে বেদনার সাগরে ডুবিয়ে দিলেন। গল্পটা নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদি এলাকায় জুলাই আন্দোলনের সময় বারান্দায় হেলিকপ্টার দেখতে গিয়ে গুলিতে নিহত সুমাইয়ার। এক বছর আগে ৬ জুলাই মারা যান সুমাইয়া।

সুমাইয়াতো বিধাতার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন। কিন্তু তার ২ মাস ১৬ দিনের শিশু সন্তান সোয়াইবাকে যেন দিয়ে গেলেন পুরো দেশের মানুষের কাছে। শিশু সোয়াইবার এখন ১ বছর পূর্ণ হয়েছে। গত বছর এই দিনেও সে মায়ের কোলেই ছিল। শিশুটি জানেও না মা চলে গেছে না ফেরার দেশে। মায়ের সঙ্গে নেই তার কোনো স্মৃতি। 

সোয়াইবার মতো আরেক অভাগী সুমাইয়ার মা আসমা বেগম। আদরের ছোট মেয়েকে (সুমাইয়া) হারানোর সঙ্গে সঙ্গে যেন হারিয়ে ফেলেছেন নিজের সমস্ত সুখ। তার চোখের পানি যেন শেষ হয় না। সেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আজও তিনি আকাশে তাকিয়ে থাকেন। সেদিন বারান্দা থেকে কিছু দূরেই উড়ছিল হেলিকপ্টার। রুম থেকে দৌড়ে হেলিকপ্টার দেখতে আসার পরক্ষণেই মেঝেতে ঢলে পড়ে সুমাইয়া। তারপর শুধু রক্ত আর রক্ত। মেয়েকে হারানোর সেই দিনের স্মৃতি তাকে এখনও ঘুমোতে দেয় না। বার্ধক্যের ভারে আজ আসমা বেগম নিজেও অসুস্থ। চলাফেরা করতে তার কষ্ট হয়। তবুও মনের জোরেই স্বপ্ন দেখেন শিশু সোয়াইবাকে ডাক্তার বানাবেন। দেশের মানুষের কল্যাণে তাকে বিলিয়ে দেবেন।

নিহত সুমাইয়ার মা ও তার ছোট্ট শিশু

আসমা বেগম বলেন, আমি মা হইয়া ওরে বাঁচাইতে পারি নাই। শেষ সময় সুমাইয়া এই কথাটা বলতে পারে নাই যে-মা আমার মেয়েটারে (সোয়াইবা) একটু দেইখা রাইখেন। আমার চোখের সামনে চইলা গেল। সেদিন গুলি লাগার আগে ডাইনিং রুমে বইসা পিঠা খেয়ে সোয়াইবাকে ঘুম পাড়াইছে। পরে হেলিকাপ্টারের আওয়াজ শুনে দেখার জন্য বলছিল  ‘সবাই দেখে আমিও দেখমু’। 

সরকারের কাছে আসমা বেগম দাবি জানিয়ে বলেন, আমার নাতনিটার দিকে যেন সুদৃষ্টিতে তাকায়। আমি বিচার চাই এমন যেন কোন সরকার আসলে আর কারও মায়ের বুক খালি না হয়। আমার নাতিতো নিষ্পাপ। ওতো জানে না ওর যে বাবা নেই মা নেই। ও যখন বড় হয়ে জানতে চাইবে ওর মা কই বাবা কই তখন আমি কী জবাব দিবো? এই হিসাব ওরে আমি কীভাবে দিবো? 

সুমাইয়ার বড় ভাই মো. শাকিল বলেন, ওর মারা যাওয়ার ঘটনাটা আমার দিলে গিয়ে লাগছে। সুমাইয়া মারা যাওয়ার পর সোয়াইবা ২ দিন চোখ মেলে তাকাইতে পারে নাই। অনেক ভয়ে ছিলাম বাচ্চাটা তখন কিছু খায় নাই। আমরা সবাই ছোট বাচ্চাটার ভবিষ্যত নিয়ে অনেক চিন্তিত। তার (সোয়ইবা) মা-বাবা নেই এখন আমরাই দেখছি। আমার মা (আসমা বেগম) সোয়াইবাকে দেখাশোনা করে তিনিও মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে যায়। তারপরও আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করছি বাচ্চাটাকে ভালো রাখার জন্য। এখন সরকার থেকে যদি আমাদের কিছু সাহায্য করে তাহলে আমরা আরেকটু ভালো থাকব। 

সুমাইয়ার ছোট ভাই মো. সজল জানায়, আমরা ভাবতেও পারি নাই এমন একটা ঘটনা ঘটে যাবে। আমরা এর বিচার চাই। আমার বোন যে বাচ্চা রেখে গেছে এর দায় ভার কে নেবে? আমার বোন যে এভাবে মারা গেছে এর পিছে কারণ কী? সে তো কোনো আন্দোলনেও যায় নাই। কোনো মিছিলে যায় নাই। ঘরের মধ্যে যদি মানুষ নিরাপদে না থাকতে পারে তাহলে কোথায় নিরাপদে থাকবে। আমার বোন হত্যার দায় কার? আমি আমার বোন হত্যার বিচার চাই।

সুমাইয়ার বড় বোনের জামাই মো. বিল্লাল বলেন, শিশু সোয়াইবা ২ মাস ১৬ দিনের মাথায় তার মাকে হারিয়েছে। সুমাইয়ার মেয়েটাকে যেন সরকার তার নিজ দায়িত্বে নিয়ে যায়। সে যেন কখনও বুঝতে না পারে তার মা-বাবা নেই। পরিবারটাকে যেন সরকার সুদৃষ্টিতে রাখে এবং মামলার চার্জশিট যেন দ্রুত দেওয়া হয় সেই দাবি জানাই।

নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলম মিঞা বলেন, জুলাই আন্দোলনে এই জেলায় ২১ জন শহীদ হয়েছেন এছাড়া ২৫৫ জন আহত হয়েছেন। আমরা প্রায় ৫ কোটি টাকার ওপরে তাদের সহায়ত করেছি। জেলা পরিষদ থেকে শহীদ পরিবারকে ৪২ লাখ টাকা আমরা সহায়তা করেছি। এছাড়া ১০টা শহীদ পরিবারকে ১০ লাখ টাকা করে সঞ্চয়পত্র দিয়েছি। আর বাকিটা আমাদের কাছে এসেছে সেটা দ্রুতই বাকি ৯ পরিবারের হাতে তুলে দিবো। এছাড়া যারা আহত হয়েছে এর মধ্যে ৬ জনকে ২ লাখ টাকা বাকিদের ১ লাখ টাকা করে প্রদান করেছি। এছাড়া ঈদের সময় আমরা শহীদ পরিবারের পাশে থেকেছি এবং সহায়তা করেছি। আমরা সামনের দিনেও তাদের পাশে আছি তাদের সহায়তা করবো। শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে যে দাবি গুলো আসছে আমরা সেগুলো যথাযথভাবে অ্যাড্রেস করার চেষ্টা করছি। আগামীতেও তাদের যে ধরনের সমস্যাই আসুক আমরা তাদের পাশে থেকে সেগুলো সমাধান করব।