Image description

এক দশকে জলবায়ু তহবিলের টাকায়  দেশের দুই শতাধিক  পৌরসভার জলাবদ্ধতা নিরসন, পরিবেশ উন্নয়ন, অবকাঠানো নির্মাণ, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ইকো পার্ক, ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ, বাস টার্মিনাল তৈরি, কলেজ ভবন নির্মাণ, রাস্তাঘাট মেরামত, পুকুরের ঘাট বাঁধানো, ধান-গম-ডাল ও তৈলবীজ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা হয়। এই তহবিলের টাকায় একের পর এক সড়কবাতি বসানোর প্রকল্প নেয়া হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদগুলোতে এ কাজে বিপুল পরিমাণ অর্থব্যয় করা হয়। যদিও সড়কবাতি বসানোর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। খোদ জলবায়ু বিশেষজ্ঞরাই এমন কথা বলছেন।

এদিকে খরস্রোতা নদী ও ভাঙনকবলিত এলাকা রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ করার কথা থাকলেও সরকার এ ধরনের প্রকল্পকেও অগ্রাধিকারে রাখেনি। অন্যদিকে সড়কে জলবায়ু তহবিলের টাকায় বসানো সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল ও বাতি বেশি দিন টিকছেও না। জলবায়ুর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ফরিদপুর চরভদ্রাসন উপজেলার চর হরিরামপুর ইউনিয়নের সবুল্লা শিকদারের ডাঙ্গী গ্রামের লোকমান  হোসেন সিকদার মানবজমিনকে বলেন, প্রতি বছরই আমাদের জমি কমছে। আগে যার ১০ কানি জমি ছিল। এখন তার পাঁচ কানিও নেই। নদী ভাঙন আমাদের ভূমিহীন করছে। এভাবে চলতে থাকলে চাষাবাদের জমিও থাকবে না। গ্রামের পর গ্রাম আবাসজমি পদ্মা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম আসলে আমাদের ঘরবাড়ি ও স্থান পরিবর্তন করতে হয়।

গত ১০ বছরে অন্তত ৬ বার আমার বাড়ি ভেঙে নদীতে চলে গেছে। এক জায়গা ভেঙে গেলে অন্য জায়গায় যাই। পরের বছর সেখান থেকে বাড়িঘর ভেঙে নিয়ে পালাতে হয়। এটাই আমাদের পদ্মা নদীর পাড়ের মানুষের জীবন। যুগ যুগ ধরে এভাবেই চলছে। কেউ আমাদের দিকে তাকায় না।  দেশের অনেক জায়গায় বসতভিটা ও জমি রক্ষায় বাঁধ  তৈরি হয়। আমরা কখনো তা দেখিনি। আমাদের এখানে কখনো বাঁধ হয়নি। আমরা গত ৫০ বছর ধরে নদীর সঙ্গে যুদ্ধ করেই বেঁচে আছি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৪ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পাউবো ও স্থানীয় সরকার বিভাগ ফরিদপুরের নয়টি উপজেলার ৬টি পৌরসভায় অন্তত ১৫ কিলোমিটার এলাকায় সড়কবাতি স্থাপন করেছেন। আর এই অর্থের জোগান এসেছে জলবায়ু তহবিলের টাকা থেকে। এতে জলবায়ু সমস্যার শিকার এই জেলার হাজার হাজার মানুষ প্রকৃত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

কোথায় গেল জলবায়ুর টাকা: জলবায়ু তহবিলের অনুদানের টাকা দিয়ে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরের টার্মিনাল এলাকার মালবাহী কন্টেইনার স্টেশন সেড, ওয়ার্কশপ ও সাব-স্টেশনের ছাদের উপর সৌর প্যানেল স্থাপন করা হয়। ২০২৩ সালে ১৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি শুরু করা হয়। এখনো প্রকল্পটির কাজ চলমান আছে। জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের বরাদ্দককৃত টাকায় গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর, কোটালিপাড়া, টুঙ্গীপাড়া ও  গোপালগঞ্জ সদর পৌরসভায় অন্তত ১০ কিলোমিটার এলাকায় সড়কবাতি লাগানো হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২০২১ থেকে ২০২২ সালে প্রকল্পটি শেষ হয়। পরের বছরই জলবায়ু তহবিলের অনুদানের টাকায় মুকসুদপুর উপজেলায় রাস্তা নির্মাণের কাজ করা হয়।

জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের টাকায় জামালপুর পৌরসভায় ৩ কিলোমিটার সড়কবাতি স্থাপন করা হয়। ২ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি ২০২০ সালে শেষ হয়। জলবায়ুর টাকায় মেহেরপুর জেলার গাংনী পৌরসভায় আরসিসি রাস্তা ও ড্রেন নির্মাণ করা হয়। ২০২০ সালে প্রকল্পটি শেষ হয়। এই তহবিলের অনুদান পাওয়া টাকায় ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলার কুতিকুড়া টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজে একটি ভবন নির্মাণ করা হয়। প্রায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৯ সালে প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়। জলবায়ু তহবিলের অনুদানের টাকায় খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলার ৪৩ একর জমির ওপর শেখ রাসেলের নামে একটি ইকো পার্ক নির্মাণ করা হয়। প্রকল্পটিতে ৮ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়।

২০১৯ সালে এর কাজ শেষ হয়। ২০১৮ সালে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের তহবিলের টাকা পিরোজপুরের কাউখালি উপজেলায় ১০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙন হতে ভূমি পুনরুদ্ধার ও মাদারীপুর শহরের রিভার ভিউ পার্ক সংরক্ষণে একটি প্রকল্প নেয়া হয়। প্রায় ৬ কোটি টাকার প্রকল্পটির ২০১৮ সালে কাজ শেষ হয়। ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার জলবায়ুর টাকায় একটি বাস টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়। ২০১৭ সালে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই বাস টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়। এ ছাড়া ২০১১ সালে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের টাকায় বিভিন্ন জেলায় ধান, গম, ডাল ও তৈলবীজ উৎপাদন প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিতরণ প্রকল্প নেয়া হয়। ওই প্রকল্পে খরচ করা হয় ২৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জলবায়ু তহবিলের টাকায় ২০১৪ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নয় বছরে দেশের অন্তত ২০২টি পৌরসভায় ২০৫টি সড়কবাতি স্থাপনের প্রকল্প নেয় সরকার। এসব প্রকল্পে তহবিল থেকে ৩৫০ কোটি টাকা খরচ করা হয়। যা জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের মোট প্রকল্পের প্রায় ৭০ শতাংশ। এ ছাড়া পৌরসভায় নর্দমা নির্মাণের জন্য ২৩টি প্রকল্প অনুমোদিত হয়। এতে ব্যয় হবে ৪১ কোটি টাকা। বাকি ৯০টি প্রকল্পের মধ্যে ইকো-ট্যুরিজম, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, মাটির ক্ষয়রোধ, উর্বরতা শক্তির  হ্রাস ঠেকানো, জলাশয়ে সবজি ও মসলা চাষ, সারা দেশে বনায়নের লক্ষ্যে চারা উৎপাদন, পরিবেশবান্ধব জলবায়ু-সহনীয় গৃহনির্মাণ, জাতীয় উদ্যানের জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ, নিরাপদ পানি সরবরাহ ইত্যাদি বিষয়ে প্রকল্প রয়েছে। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরে জলবায়ু তহবিলের টাকায় শুরু হওয়া গুরুত্বহীন অন্তত ৬৮টি প্রকল্প বাতিল করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছু জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের এক কর্মকর্তা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন বিষয়ক প্রকল্প নিতে প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা ঝামেলাপূর্ণ। বাস্তবায়ন করাও কঠিন। অন্যদিকে সড়কবাতি প্রকল্পের বাস্তবায়ন সহজ। সাধারণ মানের সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল কিনে একটি খুঁটি গেঁড়ে সেটি বসিয়ে দিলেই হলো। কাজ সহজ হলেও মুনাফা অনেক বেশি। তাই এসব প্রকল্প বেশি নেয়া হয়। এদিকে কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একেকটি সড়কবাতি বসাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল বছরভেদে সোয়া লাখ টাকা থেকে পৌনে দুই লাখ টাকা। ভালোমানের সৌর প্যানেল, ব্যাটারি ও খুঁটির দাম এখন ৬০ হাজার টাকার আশপাশে।

জলবায়ু পরিবর্তন তহবিল সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মূলত বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনা ও মুখ দেখে দেখে এসব প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। এনিয়ে বিভিন্নভাবে অবৈধ লেনদেন হয়। এমন একটি প্রকল্প ভোলার জ্যাকব টাওয়ার। এই টাওয়ার নির্মাণে ব্যয় হয় প্রায় ২০ কোটি টাকা। এর উচ্চতা ২২৫ ফুট। ১ একর জমিতে টাওয়ার নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে চরফ্যাশন পৌরসভা। তৎকালীন এমপি আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের নামে এই প্রকল্প নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। গত বছরের ১৮ই জুন সংসদে জানানো হয়, ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে এই সময় পর্যন্ত জলবায়ু তহবিলে মোট তিন হাজার ৮৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। এই অর্থ দিয়ে ৮৫০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়।  এ বিষয়ে বোর্ডের সদস্য ইমেরিটাস অধ্যাপক ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সড়কবাতি বসানো ও নর্দমা নির্মাণের কোনো সম্পর্ক নেই। বিগত পাঁচ বছরে সড়কবাতি ও নর্দমার বহু প্রকল্প নেয়া হয়েছে, যা অনুমোদন করাই উচিত হয়নি। পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ইনামুল হক বলেন, অনেক প্রকল্প হয় যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নাই। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে অর্থ খরচ করা হয়।  শেখ হাসিনার সময়ে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে যে জলবায়ুর জন্য অনেক কাজ হচ্ছে। আসলে জনস্বার্থে কোনো কাজ হয়নি। জানতে চেয়ে বন পরিবেশ ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দ রিজওয়ানা হাসানকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। মুঠোফোনে খুদে বার্তা দেয়া হলেও সাড়া দেননি।