
চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতি (জুলাই-ডিসেম্বর) প্রণয়নে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এক্ষেত্রে দেশের মানুষ কী চায়, সে বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
আরও জানা যায়, নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে জুলাইয়ের শেষদিকে। এখন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রস্তুতি শুরু করেছে। প্রস্তুতির অংশ হিসাবে গত মুদ্রানীতির লক্ষ্য ও অর্জনগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এর মধ্যে কতুটুকু ফারাক রয়েছে, কেন লক্ষ্য অর্জিত হয়নি-সেগুলো বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে মে পর্যন্ত তথ্য রয়েছে। চলতি মাসের মাঝামাঝি জুন পর্যন্ত তথ্য চলে আসবে। তখন লক্ষ্য ও অর্জনের মধ্যকার ব্যবধান আরও স্পষ্ট হবে। এছাড়া মুদ্রানীতির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে স্টেকহোল্ডারদের (অংশীজন) প্রত্যাশা কী, তা জানতে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব আলোচনায় স্থবির ব্যবসা-বাণিজ্য সচল করতে ঋণের সুদহার কমানো, টাকার প্রবাহ বাড়িয়ে বেসরকারি খাতে ঋণের জোগান বাড়ানো এবং কর্মসংস্থানের হার ব্যাপকভাবে বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আগামী মুদ্রানীতিতে বিবেচনা করা হবে।
সূত্র জানায়, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমন করলে বৈশ্বিক মন্দা দেখা দেয়। এ মন্দা ক্রমেই প্রকট হয়। মন্দার কারণে ডলার সংকটে জর্জরিত হয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি একেবারে কাবু হয়ে পড়ে। টাকার মান কমে, পণ্যমূল্য বেড়ে এবং কর্মসংস্থান কমে এর ধকল সাধারণ ভোক্তাপর্যায়ে দারুণভাবে আঘাত করে। এখনো এর ধকল কাটিয়ে ওঠতে পারেনি বাংলাদেশ।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, তিন অর্থবছর ধরে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। এবার এই মুদ্রানীতি কিছুটা শিথিল করা প্রয়োজন। দেখা যাক, বাংলাদেশ কী করে।
মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির লাগাম টানতে ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি গ্রহণ করা হচ্ছে। ২০২৪-২৫ পর্যন্ত টানা তিন অর্থবছর সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। আইএমএফ-এর চাপে ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে আরও কঠোর করা হয়েছে। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে মুদ্রানীতিকে আরও বেশি কঠোর করে। ফলে নীতির সুদহার যেখানে ৪ শতাংশ ছিল, তা বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়। ঋণের সুদহার যেখানে ৮ থেকে ৯ শতাংশ ছিল, এখন তা বেড়ে ১২ থেকে ১৮ শতাংশে উঠেছে। এত চড়া সুদ দিয়েও ব্যাংক থেকে অনেকে ঋণ পাচ্ছেন না। কারণ, ব্যাংকে গত সরকারের আমলে লুটপাটের কারণে তারল্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। তারল্য যেটুকু আছে, এর মধ্য থেকে সরকারই সবচেয়ে বেশি ঋণ নিচ্ছে। সরকারকে ঋণ দেওয়ার পর বেসরকারি খাতে ঋণ দেওয়ার মতো তারল্য খুব কমই আছে। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ তলানিতে নেমেছে। সদ্য বিদায়ি অর্থবছরের বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। জুলাই থেকে মে পর্যন্ত বেড়ে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ১২ শতাংশ, যা এখন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অর্ধেকের সামান্য বেশি। তবে জুনে প্রবৃদ্ধি আরও বাড়বে। গত অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়েছিল ৭ দশমিক ১৯ শতাংশ।
সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির কারণে একদিকে ঋণের সুদহার বেড়েছ, অন্যদিকে বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়েনি। ফলে ব্যাংকে তারল্যের জোগান বাড়েনি। এতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমেছে। ফলে কর্মসংস্থান বাড়েনি, উলটো আরও কমেছে। টানা তিন বছর সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির কারণে উৎপাদন খাতে যেমন নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তেমনই কর্মসংস্থানের হার হ্রাস পেয়েছে। গত বছরের যে ছাত্র আন্দোলন পরিচিত পেয়েছে কোটাবিরোধী আন্দোলন হিসাবে, এর নেপথ্যে ছিল অর্থনৈতিক সংকট। কয়েক বছর ধরে লুটপাটের কারণে দেশ থেকে টাকা পাচার হয়েছে। ফলে দেশে শিল্প গড়ে ওঠেনি। নতুন নতুন কর্মসংস্থান বাড়েনি। এতে শ্রমবাজারে যারা আসছে, তাদের সরকারি চাকরি ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির কারণে নতুন ব্যবসার দুয়ারও ছিল একরকম বন্ধ। কোটার কারণে মেধাবীরা সরকারি চাকরিতে ঢুকতে পারছিল না। ফলে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে বাঁচতে শুরু হয় কোটাবিরোধী আন্দোলন। সে আন্দোলনের ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে গত বছরের ৫ আগস্ট। এক বছর হতে চলেছে, এখনো কর্মসংস্থানের গতি বাড়ানো যায়নি। রাজনৈতিক অস্থিরতা, চড়া সুদহার এবং বিনিয়োগ পরিবেশ না থাকায় কর্মসংস্থান বাড়ছে না। এদিকে আইএমএফ ঋণের শর্ত হিসাবে মূল্যস্ফীতি কমাতে মুদ্রানীতিকে ব্যবহার করার চাপ দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে এককভাবে মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব নয়-এটি মানতে নারাজ। কারণ, তারা অন্যান্য দেশের উদাহরণ দিচ্ছে। অনেক দেশ মুদ্রানীতি ব্যবহার করে মূল্যস্ফীতি কমাতে সক্ষম হয়েছে। ফলে বাংলাদেশও পারবে। কিন্তু এটাও মানছে না যে, অন্য দেশের অবস্থা আর বাংলাদেশের অবস্থা এক নয়। অন্য দেশে মুদ্রানীতি দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বাংলাদেশে সেটি সম্ভব নয়।
আইএমএফ চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থছাড়ের সময়ও বলেছে, মূল্যস্ফীতির হার সন্তোষজনক পর্যায়ে নেমে না আসা পর্যন্ত সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করতে হবে। সন্তোষজনক বলতে বোঝানো হচ্ছে, ৫ থেকে ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতির হার। গত বছরের জুলাইয়েই এ হার বেড়ে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠেছিল। বর্তমান সরকারের সময়ে ডলারের দাম স্থিতিশীল থাকা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছাপানো টাকায় সরকারের ঋণের জোগান দেওয়া বন্ধ করা এবং পণ্যমূল্য কমানোর ফলে মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে। গত মে মাসে এ হার কমে ৯ দশমিক ০৫ শতাংশে নামে। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। গত জুলাইয়ে এ হার ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ উঠেছিল। জুনে মূল্যস্ফীতির হার আরও কিছুটা কমবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ হার ৬ শতাংশের মধ্যে নেমে আসবে বলে আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন জুলাই বিপ্লবের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা কর্মসংস্থানের দিকে সবচেয়ে নজর দিতে চায়। ফলে মুদ্রানীতিতে আগের কঠোরতা আর রাখতে চাচ্ছে না। কিছুটা শিথিল করতে চায়। এজন্য কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণের জোগান বাড়াতে চায়। এ লক্ষ্যে এসব খাতে কম সুদে ঋণের জোগান দিতে চায়। ইতোমধ্যে এনজিও লিংকেজ ঋণ কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। পিকেএসএফ-এর মাধ্যমে এসব খাতে ঋণের জোগান বাড়ানোর কৌশল নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যেসব তহবিল রয়েছে, সেগুলো থেকেও ঋণের জোগান বাড়ানো হবে। কারণ, এগুলোর সুদহার তুলনামূলকভাবে অনেক কম। ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করা হবে এসব তহবিল থেকে উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে।
চলতি বাজেটে অনেক খাতে কর সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব খাতে ঋণের জোগান বাড়াবে। এছাড়া বড় শিল্প ও রপ্তানি খাতকেও চাঙা করা হবে, যাতে কর্মসংস্থানের হার বাড়ে। এছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ আনার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। মুদ্রানীতিতেও সে সুযোগ দেওয়া হবে। এর মাধ্যমেও কর্মসংস্থান বাড়ানো হবে। সরকারি খাতের যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে, সেগুলো চালু করা হবে। যেগুলো সম্প্রসারণ করার সুযোগ আছে, সেগুলোর কলেবর বাড়ানো হবে। এভাবে সরকারি খাতেও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে।
নতুন সরকারের সময়ে মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য ছিল ডলার বাজার স্থিতিশীল করা। সেটি অর্জিত হয়েছে। ফলে এখন একটু ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগ বাড়ানোর কৌশল নিতে প্রস্তুত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এক্ষেত্রে আইএমএফ আপত্তি করলে সেটি উপেক্ষা করা হবে।
বৃহস্পতিবার মুদ্রানীতি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাজশাহীতে মতবিনিময় করেছে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, সমাজকর্মী ও এনজিও প্রতিনিধিরা। তারা এক বাক্যে সুদের হার কমানোর মত দিয়েছেন। এরপর সিলেটেও মতবিনিময় করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া ঢাকায় বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, অর্থনীতিবিদ ও অন্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মতবিনিময় করবে। তাদের মতামতের ভিত্তিতে মুদ্রানীতির খসড়া প্রণীত হবে। কারণ, এবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইএমএফ-এর মতামতকে নয়, সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবে দেশের মানুষ কী চায় তার ওপর।
এদিকে আইএমএফ-এর রাজস্ব খাত সংস্কারের শর্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকার তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। মুদ্রানীতিতে একই ধারা রাখলে ব্যবসায়ীরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর খেপে যেতে পারে-এমন আশঙ্কাও করা হচ্ছে। কারণ, ইতোমধ্যে সুদের হার কমানোর জোর দাবি তুলেছেন তারা।