
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গত ১৫ বছরে গুমের শিকার হয়েছেন হাজারো মানুষ। অপহরণের পর ভুক্তভোগীদের অনেককে নেওয়া হতো ‘হাসপাতাল’ আর ‘ক্লিনিকে’। তবে সেই হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ছিল না কোনো চিকিৎসক। ছিল না ওষুধপত্র বা অপারেশন থিয়েটার। সেখানে ছিল প্লাস, সুঁই, ইলেকট্র্রিক শক মেশিন, ঘূর্ণায়মান চেয়ার থেকে শুরু করে নির্যাতনের নানা সরঞ্জাম। এ হাসপাতাল-ক্লিনিকে অপহৃতদের আটকে রাখা হতো বছরের পর বছর। চালানো হতো অমানুষিক নির্যাতন। তুলে ফেলা হতো হাত-পায়ের নখ। দেওয়া হতো ইলেকট্র্রিক শক। তবে ভুক্তভোগীদের গগনবিদারী চিৎকার কোনোভাবেই সেই হাসপাতালের চার দেয়ালের বাইরে আসতে পারত না।
ভুক্তভোগীদের বর্ণনার ভিত্তিতে অনুসন্ধান করে উত্তরায় বিমানবন্দরের কাছে র্যাব-১ কম্পাউন্ডে ও র্যাব সদর দপ্তরে এমন ‘হাসপাতাল’ ও ‘ক্লিনিক’ খুঁজে পেয়েছে গুম কমিশন। র্যাব ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের এই বন্দিশালাকে তারা হাসপাতাল ও ক্লিনিক নামে ডাকত বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। এ হাসপাতালেই আট বছর বন্দি ছিলেন ব্যারিস্টার মীর আহমাদ বিন কাসেম আরমান। ২০১৬ সালের ৪ আগস্ট রাতে মিরপুর ডিওএইচএসের বাসা থেকে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। গত বছরের ২৯ অক্টোবর গুমসংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারিতে করা অভিযোগে তিনি জানান, তাকে একটি জায়গায় নিয়ে গিয়ে পুরোনো একটি নির্জন কক্ষে বন্দি করে রাখে। সেখানে তাকে ১৬ দিন রাখা হয়। পরে তাকে অন্য একটি জায়গায় নেওয়া হয়। তাকে যেখানে রাখা হয় তার খুব কাছেই ছিল ইন্টারোগেশন রুম। ইন্টারোগেশনের আওয়াজ শুনতে পেতেন। যাদের ওপর নির্যাতন চলছে তাদের আওয়াজে ঘুমাতে পারতেন না। সেখানেই ছিলেন আট বছর। এই সময়ে তিনি কোনো প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের ছোঁয়া পাননি। কখন দিন হচ্ছে, কখন রাত হচ্ছে বুঝতে পারতেন না। বেশির ভাগ সময় চোখ থাকত বাঁধা। এমনকি কোন জায়গায় আছেন তাও জানতে পারেননি। তবে বিমান অবতরণ ও ট্রেনের আওয়াজ শুনতে পেতেন। গুম করার কয়েক মাস পরে তাকে হত্যা করে ইট বেঁধে লাশ নদীতে ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয় বলে এক প্রহরী তাকে জানিয়েছিল। কিন্তু হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের একজন বড় কর্মকর্তা সিলেটে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হলে সেই পরিকল্পনা পিছিয়ে যায়।
তিনি জানান, জীবিত ব্যক্তিদের জন্য এই বন্দিশালা ছিল একটি কবরের মতো। এমনভাবে বন্দিদের নির্যাতন করা হতো, যাতে বন্দিরা মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। ব্যারিস্টার আরমানের বর্ণনায় কমিশন নিশ্চিত হয় তাকে ডিজিএফআইয়ের জেআইসিতে আটক করা হয়নি। তাহলে কোথায়? বিভিন্ন আয়নাঘর ঘুরেও বর্ণনার বিষয়বস্তু খুঁজে পাচ্ছিল না কমিশন। ধারণা করা হয় র্যাব সদর দপ্তর পরিচালিত টিএফআই সেন্টারে হয়তো রাখা হয়েছিল তাকে।
সেখানে গিয়ে ব্যারিস্টার আরমানের বর্ণনামতে অনেক কিছুর মিল পাওয়া গেলেও তাকে যে ছোট্ট কুঠুরিতে রাখা হয়েছিল তা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এ ছাড়া পুরো অবকাঠামো ছিল জরাজীর্ণ। মনে হচ্ছিল দীর্ঘদিন ওই স্থানে কেউ যায়নি। একপর্যায়ে মিলে যায় একটি গোপন দেয়াল। সেটি ভাঙতেই বেরিয়ে আসে গোপন কুঠুরি, যেখানে রাখা হয়েছিল ব্যারিস্টার আরমানকে। র্যাব-১ কম্পাউন্ডের মধ্যে অবস্থিত এই গোপন বন্দিশালাটিকে কর্মকর্তারা হাসপাতাল নামে ডাকতেন বলে জানিয়েছেন সেখানে থাকা বন্দিরা।
এ ছাড়া র্যাব সদর দপ্তর প্রাঙ্গণের মধ্যে আরেকটি বন্দিশালা পাওয়া যায়, যা ‘ক্লিনিক’ নামে পরিচিত। বাইরের অংশ কাচের প্যানেলযুক্ত থাকায় এটি ‘কাচের ঘর’ নামেও পরিচিত ছিল। ভুক্তভোগীদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে গত এপ্রিল মাসে কাচের ঘরটি আবিষ্কার করে গুম কমিশন। তবে তাদের পরিদর্শনের আগে এই কাঠামোটিরও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রমাণ ধ্বংসের চেষ্টা করা হয়েছে বলে নিশ্চিত হয় কমিশন।
তারা দেখতে পান অনেক নির্যাতন যন্ত্র একই সময়ের মধ্যে ভেঙে ফেলা হয়েছে ও অপসারণ করা হয়েছে। এসব সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে ঘূর্ণায়মান চেয়ার, বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার যন্ত্র ও তাপ নির্যাতন প্রয়োগের জন্য বিশেষ যন্ত্র। এই যন্ত্রে একজন বন্দিকে পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে একটি চেয়ারে বসানো হতো। হাঁটুর ঠিক নিচ পর্যন্ত পা পানিতে ডুবিয়ে ধীরে ধীরে সেই পানি উত্তপ্ত করা হতো। জীবিতদের সাক্ষ্যে আরও অনেক নির্যাতনের সরঞ্জামের কথা উঠে এসেছে।