Image description

জাতিসংঘের মনোনীত নতুন দূতকে নিয়ে তৈরি হয়েছে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। বাংলাদেশে জাতিসংঘের পরবর্তী আবাসিক সমন্বয়ক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া কূটনীতিক একজন সমকামী। বর্তমানে পাপুয়া নিউগিনিতে কর্মরত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক রিচার্ড এস হাওয়ার্ডকে বাংলাদেশে নতুন দূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।

এই নিয়োগের বিষয়টি ইতোমধ্যে জাতিসংঘ সদর দপ্তর থেকে বাংলাদেশকে জানিয়ে অ্যাগ্রিমো চাওয়া হয়েছে। রিচার্ড হাওয়ার্ড তার সমকামী পার্টনারকে নিয়েই বাংলাদেশে আসতে চান বলে একাধিক কূটনৈতিক সূত্র আমার দেশকে জানিয়েছে। এই নিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তৈরি হয়েছে অস্বস্তি। একটি মুসলিমপ্রধান দেশে একজন সমকামীকে কীভাবে জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠান তার দূত হিসেবে নিয়োগ দেয়, তা নিয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে আলোচনা।

আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা জাতিসংঘের এই নিয়োগে রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, একজন সমকামীকে বাংলাদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্তের আগে এখানকার সামাজিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপট অবশ্যই বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল। রিচার্ড হাওয়ার্ড যদি বাংলাদেশে জাতিসংঘের দূত হিসেবে আসেন, তাহলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. এম শহীদুজ্জামান এ ব্যাপারে আমার দেশকে বলেছেন, জাতিসংঘ কীভাবে এ ধরনের বিতর্কিত ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়, তা আমার বোধগম্য নয়। তিনি বলেন, জাতিসংঘের উচিত এই বিতর্কিত নিয়োগ বাতিল করা। জাতিসংঘ এটা না করলে বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে রিচার্ড হাওয়ার্ডের অ্যাগ্রিমো প্রত্যাখ্যান করা।

জাতিসংঘের এই বিতর্কিত নিয়োগ এবং রিচার্ড হাওয়ার্ডের অ্যাগ্রিমো অনুমোদনের ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কূটনীতিক আমার দেশকে বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এটি নিয়ে অবশ্যই অস্বস্তি তৈরি হয়েছে।

রিচার্ড হাওয়ার্ডের অ্যাগ্রিমো অনুমোদন করা হবে কি না-সে ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের মধ্যে সম্পর্ক ও সহযোগিতা বহুমাত্রিক। শান্তিরক্ষী মিশনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সহযোগিতা করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের উন্নয়ন কার্যক্রমে জাতিসংঘের ভূমিকা রয়েছে। তাই বিতর্কিত কোনো কিছু আমাদের সামনে আসা উচিত নয়। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট অবশ্যই জাতিসংঘের বিবেচনায় নেওয়া উচিত।

জাতিসংঘের এই বিতর্কিত নিয়োগ বাংলাদেশ সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে উল্লেখ করে ওই কূটনীতিক বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে অগ্রসর হয়েছে। নির্বাচন সংস্কারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে মতপার্থক্যও তৈরি হচ্ছে। সব মিলিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার একটি চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছে। এখন যদি সমকামিতার মতো একটি স্পর্শকাতর ইস্যু সামনে আসে, তা নিশ্চিতভাবেই নতুন অস্থিরতা তৈরি করবে। এই পরিস্থিতি মোটেই কাম্য নয়।

ওই কূটনীতিক মনে করেন, এই পরিস্থিতিতে ভালো হয়, যদি জাতিসংঘ ঢাকায় নতুন কোনো আবাসিক সমন্বয়ক না পাঠিয়ে বর্তমানে ঢাকায় কর্মরত আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইসকে আগামী সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত রেখে দেয়। কারণ গোয়েন লুইস সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সমাজের অন্য অংশীজনদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে তার দায়িত্ব পালন করছেন।

এদিকে জাতিসংঘের এই বিতর্কিত নিয়োগ, বাংলাদেশে এর প্রভাব এবং এ ব্যাপারে সরকারের করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যাপক এম শহীদুজ্জামান আমার দেশকে বলেন, ‘আমরা সবাই স্বীকার করি, জাতিসংঘ খুবই ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ একটি মুসলিমপ্রধান দেশ। আমাদের সামাজিক রীতিনীতি এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পর্কে জাতিসংঘ নিশ্চয়ই অবগত। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না জাতিসংঘ ঠিক কীভাবে একজন সমকামীকে এখানে তাদের দূত হিসেবে নিয়োগ দিল।’

তিনি বলেন, একজন সমকামী হিসেবে রিচার্ড হাওয়ার্ড তো বাংলাদেশে এলজিবিটি প্রমোট করার চেষ্টা করবেন। এটা তো আমাদের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর ইস্যু। আমাদের সামাজিক রীতিনীতি এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের চরম পরিপন্থী। বাংলাদেশে এই বিতর্কিত নিয়োগ নিশ্চিতভাবেই অস্থিরতা তৈরি করবে। আর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে সরকার। একবার ভেবে দেখুন, এটাকে ইস্যু করে যদি ইসলামি দলগুলো রাস্তায় নামে, তাহলে কী পরিস্থিতি তৈরি হবে।

অধ্যাপক শহীদুজ্জামান জাতিসংঘের উদ্দেশে বলেন, ‘জাতিসংঘের উচিত অবিলম্বে এই অ্যাগ্রিমো প্রত্যাহার করে নেওয়া। আর জাতিসংঘ যদি অ্যাগ্রিমো প্রত্যাহার না করে, তাহলে বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে এই অ্যাগ্রিমো প্রত্যাখ্যান করা। জাতিসংঘকে সাফ জানিয়ে দেওয়া, আমরা কোনো সমকামীকে গ্রহণ করব না।’

উল্লেখ্য, রিচার্ড এস হাওয়ার্ড জুনিয়র একজন ফুলব্রাইট স্কলার এবং তিনি পিএইচডি ডিগ্রিধারী। তার গবেষণার অন্যতম মূল বিষয় লিঙ্গসমতা। ৩০ বছরের বেশি কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই সমকামী কূটনীতিক ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে পাপুয়া নিউগিনিতে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তিনি নেপালে আইএলওর কান্ট্রি ডিরেক্টর, থাইল্যান্ডে আইএলওর সিনিয়র আবাসিক বিশেষজ্ঞ, চীনে অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের স্বাস্থ্য বিভাগে প্রধান কারিগরি উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।