
দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে বিদ্যুৎ সহজলভ্য করতে সরকার ভর্তুকি দেয়; কিন্তু বাস্তবের চিত্র উল্টো। ভর্তুকির বেশিরভাগই ভোগ করছে ধনী জনগোষ্ঠী। ৪০ শতাংশ গ্রাহক মোট বিদ্যুতের ৫৪ শতাংশ ব্যবহার করে। চলমান এই ভর্তুকি ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এ জন্য আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটি স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাব করেছে। গত সোমবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ফ্যাবিয়ানা মাচাদো, নিকোলো বার্ড, নুসরাত চৌধুরী এবং আলবার্তো টুমিনো নেতৃত্বাধীন আইএমএফ দল একটি প্রতিবেদন দেয়।
‘আইএমএফ টিএ ইলেকট্রিসিটি সাবসিডি রিফর্ম বাংলাদেশ’ শিরোনামে দেওয়া প্রতিবেদনটি মূলত বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ব্যবহারের ধরন এবং ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার আর্থিক কাঠামো নিয়ে গবেষণা করে দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রেজাউল করিম এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, আইএমএফ ভর্তুকি নিয়ে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছে। সে অনুযায়ী ভর্তুকি কমাতে আমরা একটি রোডম্যাপ তৈরি করব। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চেয়েছে আইএমএফ।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আইএমএফ এমন এক সময় এই সুপারিশ করেছে, যখন সরকার ক্রমবর্ধমান আর্থিক সীমাবদ্ধতা এবং আইএমএফের চাপের মধ্যে তার ভর্তুকি বোঝা কমাতে চাপের মধ্যে রয়েছে। তবে চাপ থাকা সত্ত্বেও এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নেই সরকারের। এর পরিবর্তে সরকার অভ্যন্তরীণ সংস্কার এবং দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থার মাধ্যমে খরচ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া ভর্তুকির লক্ষ্য বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকার সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নিম্ন আয়ের ব্যবহারকারীদের সরাসরি নগদ সহায়তা প্রদানের পরিকল্পনা করছে।
জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, সাবসিডিটা হচ্ছে ভুলের মাশুল। লুটপাট, ক্যাপাসিটি চার্জ, নিজস্ব লোকদের কাজ দেওয়াসহ নানা অনিয়মের কারণে ভর্তুকির চাপ বেড়েছে। তিনি বলেন, এটা ঠিক যে ভর্তুকির টাকা ধনীদের পকেটে যাচ্ছে। আমার মনে হয়, দরিদ্রদের ভর্তুকির টাকা সরাসরি দেওয়া গেলে ভালো হতো।
আইএমএফের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিদ্যুতের ভর্তুকি যাচ্ছে বড় বড় গ্রাহকের কাছে। যারা সাধারণত বড় বাড়িতে বসবাস করে এবং বেশি সংখ্যক যন্ত্রপাতি ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রক ব্যবহার করে। এর বিপরীতে দরিদ্র পরিবারগুলো তুলনামূলক অনেক কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। এ ছাড়া বড় গ্রাহকরা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে গড়িমসি করলেও দরিদ্র গ্রাহকরা শতভাগ বিল পরিশোধ করে।
প্রতিবেদনে পিডিবির আর্থিক অবস্থার অবনতির বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, দেশের একমাত্র বিদ্যুৎ ক্রেতা পিডিবি। বিদ্যমান ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ ক্রয় খরচ মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছে। যার ফলে লোকসান বাড়ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পিডিবির পাইকারি মূল্য প্রতি কিলোওয়াট/ঘণ্টা ১১ টাকা ৭৪ পয়সা, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৬ টাকা ১৮ পয়সার প্রায় দ্বিগুণ। আইএমএফ সতর্ক করেছে, বিদ্যুতের দাম সংস্কার ছাড়া বিপিডিবি তার লোকসান পুনরুদ্ধার করতে বা গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে পারবে না।
বিদ্যুৎ ব্যবহার নিয়ে প্রতিবেদনে পূর্বের একটি অর্থবছরের বিদ্যুৎ ব্যবহারের হিসাব করে বলা হয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২০ শতাংশ ধনী গ্রাহক বিদ্যুতের প্রায় ৩২ শতাংশ ভর্তুকি পেয়েছে। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে একই অর্থবছরে ২০ শতাংশ দরিদ্র গ্রাহক পেয়েছে মাত্র ১২ শতাংশ ভর্তুকি। দরিদ্র গ্রাহকরা কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করে, তবে তাদের আয়ের একটি বড় অংশ এর পেছনে ব্যয় করে। এতে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সম্মিলিতভাবে বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতে ভর্তুকি ছিল জিডিপির এক দশমিক ১০ শতাংশ। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক দশমিক ৩২ শতাংশ, যা সরকারি অর্থায়নকে আরও চাপ সৃষ্টি করছে।
প্রতিবেদনে সংস্কারের জন্য রোডম্যাপও দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, অদক্ষতা কমাতে এবং দরিদ্রদের আরও ভালোভাবে সুরক্ষিত করতে স্বল্পমেয়াদি সংস্কারে ব্লক ট্যারিফ পুনর্গঠন, লাইফলাইন ট্যারিফ সম্প্রসারণ করা এবং উচ্চ স্তরের বিদ্যুতের মূল্য ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা। পাশাপাশি দারিদ্র্যের মানচিত্র ব্যবহার করে শহর ও গ্রামীণ ব্যবহারকারীদের জন্য বিদ্যুতের পরিমাণ বাড়ানো।
মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনায় প্রস্তাব করা হয়েছে, ভর্তুকি প্রত্যাহার করা এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর গ্রাহক প্রতি মাসে ৪৮৮ টাকা দেওয়া এবং দীর্ঘ মেয়াদে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম যুক্ত করা।
প্রাতিষ্ঠানিক ও নিয়ন্ত্রক সংস্কার বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)-এর মাধ্যমে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক তদারকি, সমন্বিত ডাটা সিস্টেম, অদক্ষ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর অবসায়ন এবং স্বচ্ছ জনযোগাযোগ ও পরিষেবা উন্নতির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া এবং বার্ষিক ভর্তুকি কমানোর জন্য নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোকে চিহ্নিত করতে ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করা কথা বলা হয়েছে। আইএমএফের দেওয়া সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছে।