
সাত বছর আগে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ‘পদ্মা মেঘনা যমুনার তীরে’ সংগীতের মডেলিংয়ে অংশ নেওয়ার দায়ে সোমবার (৩০ জুন) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখা ছাত্রদলের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক শরীফ উদ্দিন সরকারকে স্থায়ী বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় সংসদ। বহিষ্কারের দুইদিন পর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিজের অবস্থান খোলাসা করেছেন তিনি।
ঢাবির বহিষ্কৃত ছাত্রদল নেতা বলেন, ‘আমার নানা ছিলেন জিয়া পরিবারের গৃহ শিক্ষক। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর আরবি শিক্ষক ছিলেন। তিনি আমাদের সবসময়ই শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শ, সততা, নিষ্ঠা এবং বেগম খালেদা জিয়ার সংগ্রাম, সততা এবং দেশপ্রেমের গল্প শোনাতেন। আমিও জিয়ার আদর্শের একজন কর্মী।’
ছাত্রশিবিরের সংগীতে মডেলিংয়ের বিষয়ে শরীফ উদ্দিন সরকার বলেন, ছোটবেলা থেকেই ইসলামী সংগীতের ওপর দক্ষতা ছিল এবং স্থানীয় অনেক পুরস্কারও অর্জন করি। আমার একসময় একটা স্বপ্ন ছিল, আমি কোনো একটা শিল্পীগোষ্ঠীতে কাজ করে একজন পেশাদার শিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করব। সেই সুবাধে সাভারে একটি মাদ্রাসার আলিম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় আমার কয়েকজন বন্ধুর মাধ্যমে ‘মল্লিক একাডেমি’ নামক একটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরিচিত হই।
পরে সেখানে গান শেখার সুযোগ পাই এবং নিয়মিত ক্লাস করতে থাকি। কিন্তু আমি জানতাম না, সেটা শিবিরের প্রতিষ্ঠান। কেউই জানত না, কারন তারা তখন প্রকাশ্যেই কাজ করত এবং বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রোগ্রাম করত। হঠাৎ একদিন ভাইয়েরা বললেন, আগামীকাল একটা গানের শুটিং হবে, আমরা যেন প্রস্তত হয়ে যাই। শুটিং স্পটে গিয়ে জানতে পারি, ওখানে শিবিরের একটা গানের শুটিং হবে। যেহেতু আমি একজন শিল্পী এবং ওই সময়ে আমার নির্দিষ্ট কোনো পলিটিক্যাল আইডিউলজি ছিল না। আমিও আপত্তি করিনি এবং কয়েক সেকেন্ডের শ্যুটে অংশ নেই।
তিনি বলেন, যেহেতু আমি সবেমাত্র এইচএসসিতে অধ্যয়নরত এবং গ্রামে বেড়ে উঠা একজন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী, তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক আইডিউলজি সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা বা জানাশোনা ছিল না। এর কিছুদিন পরেই আমার এইচএসসি এক্সাম শুরু হয়ে যাওয়ায়, আমি মল্লিক একাডেমি ছেড়ে চলে আসি এবং তাদের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখিনি। শিবিরের কোনো পদবী তো দূরে থাক, আমি কখনোই শিবিরের সাংগঠনিক রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা ছিলাম না। এইচএসসি (আলিম) পরীক্ষা এক্সাম শেষ করে এডমিশন প্রিপারেশন নেই এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) চান্স পাই।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ও প্রকাশ্যে ছাত্রদলের রাজনীতির বিষয়ে শরীফ উদ্দিন সরকার বলেন, ২০১৮ সালের শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে উঠি এবং সক্রিয়ভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য হল ছেড়ে মিরপুরের একটি মেসে উঠি। পরবর্তীতে আমি আবারও হলের গণরুমে উঠি এবং গণরুম গেস্টরুমের মানসিক অত্যাচারে আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। ২০১৮ সালের শেষদিকে আমার ছাত্রদলের ভাইদের সাথে পরিচয় হয় এবং বিভিন্ন আড্ডায় অংশগ্রহণ করতে থাকি। একদিন হল ছাত্রলীগের একজন আমাকে ছাত্রদল নেতাদের সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেখে ফেলে এবং আমারই কয়েকজন ব্যাচমেটকে নিয়ে পরিকল্পনা করে আমাকে মিথ্যা অভিযোগ দেওয়া হয়, যার সত্যতা পাওয়া যায়নি। কিছুদিন পর আমাকে হুমকি-ধামকি দিয়ে হল থেকে বের করে দেয়।
তিনি বলেন, পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে আমি প্রকাশ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের রাজনীতি শুরু করি। পরবর্তীতে হাসিনাবিরোধী এমন কোনো রিস্কি জোন নেই, এমন কোনো রিস্কি মোমেন্ট নেই, যেখানে আমার সরব উপস্থিতি ছিল না। ক্যাম্পাস এবং ক্যাম্পাসের বাহিরের প্রায় সকল প্রোগ্রামেই আমি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। ক্যাম্পাসে একাধিকবার আহতও হই। ছাত্রদলের বর্তমান নেতারা এর সাক্ষী।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের বিষয়ে শরীফ উদ্দিন সরকার বলেন, ২৮ অক্টোবর এবং এর পরবর্তী সময়ে প্রতিদিনই ঢাকার বিভিন্ন স্থানে প্রোগ্রাম করে বেরিয়েছি। প্রতিদিনই গ্রেফতার, হামলা এমনকি মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়ে বের হতাম। ছোট ভাইয়ের কাছে ছাত্রদল নেতৃবৃন্দের নাম্বার দিয়ে বের হইতাম যেন না ফিরলে অন্তত জানাতে পারে। অফলাইনের পাশাপাশি অনলাইনেও ছিলাম সরব, ঢাবির প্রায় সবাই আমাকে ছাত্রদল হিসেবেই চিনতো অনলাইন এক্টিভিটিসের জন্য ছাত্র জনতার জুলাই আগস্ট আন্দোলনে আমি ছাত্রদলের হয়ে প্রতিদিন ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করি এবং একাধিকবার আহত হই। বুক পকেটে চিঠি এবং আইডির কপি নিয়ে আন্দোলনে যেতাম যেন লাশটা অন্তত পরিবারের কাছে পৌঁছায়। ৩ আগস্ট উত্তরায় গ্রেফতারও হই এবং দুইজন পুলিশের সহায়তায় ওইদিনই ছাড়া পাই। ৫ অগস্ট চানখারপুলে আন্দোলনকারীদের সংগঠিত করার চেষ্টা করি এবং সফল হই। সেখানে আমার চোখের সামনেই ৫ জন শহীদ হয় এবং আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে অল্পের জন্য প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরি।
তিনি বলেন, ৫ আগস্ট পরবর্তীতে আমি ছাত্রদলের নিয়মিত প্রোগ্রামের পাশাপাশি অনলাইনে জামায়াত, শিবির এবং এনসিপি কর্তৃক পরিচালিত দেশব্যাপী বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জবাব দিতে থাকি এবং তাদের চক্ষুশূল হই। তখনই কেউ কেউ এই ভিডিওর স্ক্রিনশট ইনবক্সে দিয়ে আমার রাজনীতি খেয়ে দেওয়ার হুমকি দিতে থাকে। আমি আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের উপর আত্মবিশ্বাস রেখে আমার অবস্থানের উপর অটল থাকি এবং আমার কার্যক্রম চালিয়ে যাই। পরবর্তীতে তারা তাদের এজেন্টের মাধ্যমে এই ভিডিওটি ছাত্রদল নেতৃবৃন্দের কাছে পাঠায় এবং নেতৃবৃন্দ আমার কোনো বক্তব্য না শুনে বা আমাকে না জানিয়েই তড়িঘড়ি করে স্থায়ী বহিষ্কার করে দেন।
কবি জসিম উদ্দিন হল ছাত্রদলের নেতা ছিলেন ছাত্রশিবিরের সাবেক সেক্রেটারি ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদে পদায়িত হন, যেটা ছাত্রদলে ওপেন সিক্রেট উল্লেখ করে শরীফ উদ্দিন সরকার বলেন, ছাত্রদলে আমার দীর্ঘ ৭ বছরের ক্যারিয়ার, আমি যেখানে হলে থেকে ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম করে খুব সুন্দরভাবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কাটিয়ে চাকরির প্রস্তুতি নিতে পারতাম, সেখানে সকল সুখ শান্তি এমনকি জীবনের মায়া বিসর্জন দিয়ে জেল জুলুমের সম্ভাবনাকে মাথায় নিয়ে আমি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের পতাকাতলে সমবেত হয়েছি। আমি তো অন্তত আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাওয়ার অধিকার রাখি, আমাকে সেই সুযোগটাও দেওয়া হয়নি। আপনারা জানেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের অনেক নেতাকর্মীই একসময় ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল, তাদের অনেকেই ছাত্রদলের ওপর হামলায়ও জড়িত ছিল কিন্তু পরবর্তীতে তারা জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয় এবং আমি তাদের অবস্থানকে স্বাগত জানাই। ইশা ছাত্র আন্দোলন ঢাবি শাখার সাবেক সভাপতিও ফ্যাসিবাদ আমল থেকে ছাত্রদলের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্রদল করে যাচ্ছেন। কবি জসিম উদ্দিন হল ছাত্রদলের একজন নেতা হল শিবিরের সাবেক সেক্রেটারি ছিলেন এবং পরবর্তীতে তিনি শিবির থেকে বের হয়ে এসে ছাত্রদলে যোগ দেন এবং উনিও হল ছাত্রদল এবং কেন্দ্রীয় সংসদে পদায়িত হন যেটা ছাত্রদলে ওপেন সিক্রেট।
যদিও উনি দীর্ঘদিন রাজপথে তেমন এক্টিভ ছিলেন না। এ ছাড়া ৫ আগস্টের পর ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী ছাত্রদলে যোগ দেয় এবং অনেকে তেমন প্রোগ্রাম না করেও বিশ্ববিদ্যালয় কমিটিতে পদ পায়, সেগুলো আপনারা গণমাধ্যমে রিপোর্ট করেছিলেন। এর জেড়ে কয়েকজনকে অব্যাহতিও দেওয়া হয়। এ ছাড়া আরও অনেক উদাহারণ দৃশ্যমান। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দীর্ঘদিন বিভিন্ন সংগঠন করেও যদি কেউ ছাত্রদল করে যেতে পারে তাইলে আমি অবুঝ কালে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে না বুঝে একটা কাজে অংশগ্রহণ করে কেন ছাত্রদল করতে পারবোনা। আমি কেন দীর্ঘ সাত বছর আমার জীবন বাজি রেখে দলের জন্য জীবনের সবকিছু বিসর্জন দেওয়ার মূল্য পাবোনা
এই প্রশ্ন আপনাদের মাধ্যমে রেখে গেলাম ।