Image description

তারা কেউ পরিচয় দিতেন আওয়ামী পরিবারের সন্তান। আবার অনেকে ছাত্র জীবনে সরাসরি ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিলেন। এসব পরিচয়ে পেয়েছেন পদোন্নতি, পোস্টিং। আওয়ামী লীগ আমলে দাপটের সাথে চাকরি করেছেন। চব্বিশের ৫ আগস্টে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর তাদের কিছু কর্মকর্তাকে গ্রেফতার এবং কিছু কর্মকর্তা পালিয়ে গেলেও এখনো অনেকেই আছেন বহাল তবিয়তে। সময়ের প্রয়োজনে তাদের কেউ কেউ বোল পাল্টে এখন আওয়ামীবিরোধী সেজেছেন। পুলিশ বাহিনীকে চালাচ্ছেন দাপটের সাথে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুলিশ বাহিনীতে ঘাপটি মেরে থাকা এসব আওয়ামী দোসররা যেকোনো সময় তাদের অনুসারীদের বিভ্রান্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে।

একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, অতিরিক্ত আইজিপি তৌফিক মাহবুব চৌধুরী সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের স্ত্রীর বড় ভাই। শেখ হাসিনার শাসনামলে পুলিশ সদর দফতরে ডিআইজি হিসেবে (প্রশাসন, লজিস্টিকস, এইচআর) গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নেন। দলীয় সর্বোচ্চ আনুগত্য ছাড়া সাধারণত সদর দফতরে প্রশাসনের দায়িত্ব দেয়া হয় না। মামুনের সময় তিনি দোর্দন্ডপ্রতাপের সাথে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স নিয়ন্ত্রণ করতেন। হাসিনার আস্থাভাজন হওয়ায় তিনি ১২তম বিসিএসের কর্মকর্তাদের ডিঙিয়ে ১৫তম বিসিএসের অনেককে টপকিয়ে অতিরিক্ত আইজি হিসেবে পদোন্নতি পান। পদোন্নতি পাওয়ার পর থেকেই তিনি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে কর্মরত আছেন। তাকে দুই দফায় পিবিআই ও পুলিশ একাডেমিতে বদলি করা হলেও তিনি সেখানে যোগদান করছেন না। ৫ আগস্টের পট-পরিবর্তনের পর তৌফিক মাহবুব চৌধুরীকে পিবিআইতে বদলি করা হলেও তিনি পুলিশ সদর দফতর ছেড়ে যাননি। বর্তমানে পুলিশ সদর দফতরে বহাল তবিয়তে রয়েছেন এই কর্মকর্তা। তিনি কখনো বিগত হাসিনার আমলে কোনো খারাপ পোস্টিং পাননি।

ডিআইজি অ্যাডমিন, ডিআইজি লজিস্টিকস, ডিআইজি এইচআর ছাড়াও তিনি বরিশালের এসপি থাকাকালে বিরোধী মত দমনে সোচ্চার ছিলেন। ছিলেন পুলিশের বিশেষ শাখাতে (এসবি) বিশেষ পুলিশ সুপার (প্রশাসন), রাজশাহী জেলার পুলিশ সুপার, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ পদ ডিসি (সদর দফতর)।

আওয়ামী আমলের ব্যাপক সুবিধাভোগী আরেক কর্মকর্তা আবু হাসান মুহাম্মদ তারিক। জনশ্রুতি রয়েছে, অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে পদোন্নতি পান তোষামোদ ও দলবাজি করে। দলীয় আনুগত্য বিবেচনায় উত্তীর্ণ হওয়ায় পুলিশ সদর দফতরে গুরুত্বপূর্ণ একাধিক পদে ছিলেন। ছিলেন ডিআইজি ফাইন্যান্স, এইচআরসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে পুলিশ সদর দফতরে। বর্তমানে মিরপুর পুলিশ একাডেমির রেক্টর হিসেবে রয়েছেন। মাত্র এক বছরের জন্য পুলিশ একাডেমি সারদার প্রিন্সিপাল ছিলেন। তৎকালীন সময়ে ব্যাপক ক্ষমতাবান প্রলয় কুমার জোয়ার্দারের একান্ত অনুগত হিসেবে পরিচিত ছিলেন এই সিনিয়র কর্মকর্তা। আবু হাসান তারিক রাজশাহীর সারদায় পুলিশ একাডেমির অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে প্রলয় কুমার জোয়ার্দার ছিলেন পুলিশ সদর দফতরে। সে সময় সারদার পুলিশ একাডেমির বিভিন্ন কাজে অযাচিত হস্তক্ষেপ করতেন প্রলয়। সব কিছু অত্যন্ত আনন্দচিত্তে মেনে নিতেন এবং জুনিয়র অফিসারের মন জয় করার মানসিকতা নিয়ে সে সময় পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি করেন। চৌধুরী মামুন আইজি হওয়ার পরই চলে আসেন পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে ভোল পাল্টে আবার সুবিধা নিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

মো: মাসুদুর রহমান ভূঞাকেও বিগত সময়ে কয়েকজনকে ডিঙিয়ে অতিরিক্ত আইজিপি করা হয়। শেখ হাসিনার সময়ে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ছিলেন। সে সময় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের ওপর ক্র্যাকডাউনের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। গোপালগঞ্জে এসপি থাকাকালীন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের ব্যাপক আস্থা অর্জন করেন। ছিলেন হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি অতিরিক্ত ডিআইজি রাজশাহী রেঞ্জ। প্রমোশন পেয়েছেন নিয়মিত। সারদা পুলিশ একাডেমিতে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আওয়ামী লীগের শাসনামলে অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে পদোন্নতি দেয়ার আগে গোয়েন্দা রিপোর্টে তাকে আওয়ামী লীগের মতাদর্শের লোক বলে উল্লেখ করা হয়। তার বাবা জীবদ্দশায় আওয়ামী লীগ করতেন এবং তার দুই ভাই আওয়ামী লীগ করেন বলেও উল্লেখ করা হয় রিপোর্টগুলোতে। মাসুদুর রহমান ভূঞা সব সময়ই এসবি মনিরের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। গোপালগঞ্জের এসপি থাকাকালীন তিনি শেখ পরিবারের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন। বিশেষ করে শেখ হেলালের সাথে বিশেষ সখ্যতা গড়ে তোলেন। এ জন্য তিনি ১২তম বিসিএসের কর্মকর্তাদের ডিঙিয়ে ১৫তম বিসিএসের অনেককে টপকিয়ে অতিরিক্ত আইজি হিসেবে পদোন্নতি পান। অথচ তিনি একজন অযোগ্য কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। শুধু হাসিনার দোসর হিসেবে পদোন্নতি পান এসবি মনির ও শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠতার কারণে।

নৌ পুলিশের প্রধান, অতিরিক্ত আইজিপি কুসুম দেওয়ানের বিষয়ে গোয়েন্দা রিপোর্টে ফ্যাসিস্ট আমলে বলা হয়েছিল, এই কর্মকর্তা আওয়ামী মনোভাবাপন্ন। পরিবারের সদস্যরা মুজিববাদী আওয়ামী লীগের সাথে জড়িত। তার শ্বশুর শরদিন্দু শেখর চাকমা এস এস চাকমা নামে পরিচিত। চাকমা সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং নৃগোষ্ঠীদের মধ্যে প্রথম ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিসে ক্যাডার পদে যোগদান করেন। ১৯৯৩ সালে পাহাড়ী নৃগোষ্ঠীদের মধ্যে সর্বপ্রথম পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৯৪ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তিচুক্তির সময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। যার পুরস্কারস্বরূপ আওয়ামী লীগ সরকার এস এস চাকমাকে ১৯৯৮ সালে ভুটানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়। ১২ ও ১৫ ব্যাচের অনেককে টপকিয়ে পদোন্নতি ভাগিয়ে নেন। শেখ হাসিনার সময়ে অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে পুরুস্কৃত হওয়া এই কর্মকর্তা এখনো নৌ পুলিশের প্রধান হিসেবে রয়েছেন বহাল তবিয়তে।

তিনি পরিচালক, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, ভারপ্রাপ্ত কমিশনার সিএমপি, ডিআইজি সিআইডি, কমান্ড্যান্ট, রংপুর পিটিসি হিসেবে রংপুরে কর্মরত ছিলেন। সর্বশেষ ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর থেকে ১৭ অক্টোবর ২০২৪ পর্যন্ত সিআইডির অর্গানাইজ ক্রাইমের ডিআইজি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এ সময় আওয়ামী ক্যাডার চরম দুর্নীতিবাজ গোপালগঞ্জের কর্মকর্তা সিআইডির সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলীর নানা অপকর্মের সহযোগী ছিলেন কুসুম দেওয়ান। তার বাবা টুলু দেওয়ান। কলেজ গেট (মন্ত্রীপাড়া), ৯ নং ওয়ার্ড, রাঙ্গামাটি পৌরসভা। তার স্ত্রী শ্রাবণী চাকমা, কর কমিশনার, চট্টগ্রাম। মেয়ে আমেরিকায় লেখাপড়া করেন। ছাত্র জীবনে তিনি জেএসএসের (সন্তু) সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন এবং পুলিশে যোগদানের পর আওয়ামী লীগ সমর্থিত কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেন।

আওয়ামী ক্যাডার চরম দুর্নীতিবাজ গোপালগঞ্জের কর্মকর্তা সিআইডির সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলীর নানা অপকর্মের সহযোগী ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা কুসুম দেওয়ান। মোহাম্মদ আলীর মাধ্যমে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খুশি করেই ১৫ বিসিএস ব্যাচের ৪৯ জন মেধাবী, সৎ ও পেশাদার কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে সুপার নিউমারারিতে অতিরিক্ত আইজিপি হন তিনি। এর পর ১৫ বিসিএস ব্যাচের ৬৬ জন কর্মকর্তার মধ্যে ৬৫ নম্বর হয়েও তিনি নৌ পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি। ১৫ বিসিএসের বঞ্চিত কর্মকর্তা যারা এখনো ডিআইজি পদে কর্মরত তাদের ডিঙিয়ে অদৃশ্য ক্ষমতা বলে আওয়ামীপন্থী এই কর্মকর্তা নিয়োগ পেয়েছেন।

সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবদুল আলিম মাহমুদ ১২ বিসিএস ও ১৫ বিসিএসের বেশ কয়েকজনকে ডিঙিয়ে অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে পদোন্নতি দেয় শেখ হাসিনা সরকার। রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হিসেবে বিএনপি-জামায়াত নিধনের কাজে ছিলেন এক কাঠি সরষ। দায়িত্বে ছিলেন রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি হিসেবে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। শেখ হাসিনার সাথে প্রায়ই কথা বলা ও দেখা করতেন তিনি। বর্তমানে তাকে ওএসডি করে মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করে রাখা হলেও বিভিন্ন স্থানে সরকারবিরোধী মিটিংয়ে অংশ নেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া ভারতে পলাতক আওয়ামী লীগ নেতা ও কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। তার সাথে পতিত সরকারের আইজি শহীদুল হকের ছিল ব্যাপক দহরম মহরম। তাকে ধর্ম ছেলে হিসেবে তিনি ডাকতেন। এক সময় তিনি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে ডিএন্ডপিএস হিসেবে ব্যাপক প্রভাবের সাথে কাজ করেছেন। ছাত্র জীবনে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ছিলেন। ফজলুল হক হলের নির্বাচিত বার্ষিকী সম্পাদকও ছিলেন তিনি। ১৯৯১ সালে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলার নেতৃত্ব দেয়ায় সাধারণ ছাত্ররা আবদুল আলীমের ২৩৪ নম্বর কক্ষটি ভাঙচুর করেন। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করে তাকে সান্ত¡না দেন। সেই সময়কার একটি ছবি আবদুল আলীমের কাছে সংরক্ষিত ছিল। ছবিটিকে পুঁজি করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরে এই কর্মকর্তা পুলিশের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেন।