Image description
» আন্দোলনের পথ আইনিভাবে বন্ধ করছে সরকার । » জেল - জরিমানার পাশাপাশি বিধি অনুযায়ী বিভাগীয় পদক্ষেপ । » পক্ষে - বিপক্ষে মত বিশেষজ্ঞদের ।

চেয়ারম্যানের অপসারণসহ বেশ কয়েকটি দাবিতে কর্মচারীদের শাটডাউন কর্মসূচিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে ( এনবিআর ) অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে । এনবিআরের অধীন দপ্তর - সংস্থার কর্মচারীরাও কাজ করছেন না । এমন পরিস্থিতিতে এনবিআর ও এর অধীন দপ্তর - সংস্থার সব শ্রেণির চাকরিকে অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস হিসেবে ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার ।

গতকাল রোববার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয় । ফলে ধর্মঘট ও লকডাউনের মতো কর্মসূচি পালন করলে জেল - জরিমানার মুখে পড়বেন কর্মচারীরা । উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের বিবৃতিতে বলা হয় , ‘ অতি জরুরি আমদানি - রপ্তানি ও বৈদেশিক বাণিজ্যের কার্যক্রম চলমান রাখার জাতীয় স্বার্থে সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতাধীন সব কাস্টম হাউস, আইসিডি , বন্ড কমিশনারেট এবং শুল্ক স্টেশনগুলোর সব শ্রেণির চাকরিকে অত্যাবশ্যক সেবা ঘোষণা ব্যবসায়ী নেতাদের উদ্যোগ, শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহার নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পর গতকাল রোববার রাতে কমপ্লিট শাটডাউনসহ সব কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ( এনবিআর ) আন্দোলনরত কর্মকর্তা- কর্মচারীরা । সংকট নিরসনে এই বৈঠকের আগে ব্যবসায়ী নেতারা অন্তর্বর্তী সরকারে অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস ঘোষণা করার অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছে । ”

এতে আরও বলা হয় , ‘ আমরা আশা করি , অনতিবিলম্বে কর্মকর্তা- কর্মচারীরা কর্মস্থলে ফিরে যাবেন এবং আইনবিরোধী ও জাতীয় স্বার্থবিধ্বংসী কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসবেন । অন্যথায় দেশের জনগণ ও অর্থনীতির সুরক্ষায় সঙ্গে বৈঠক করেন । ওই বৈঠকে তাঁরা উপদেষ্টাকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনার আহ্বান জানান । রাজধানীর তেজগাঁওয়ে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির ( বিসিআই ) কার্যালয়ে রাতে ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে এনবিআরের কর্মকর্তাদের বৈঠক হয় ।

সরকার কঠোর হতে বাধ্য হবে । ' এর আগে এনবিআর এবং এর অধীন দপ্তর ও সংস্থার সব শ্রেণির চাকরিকে অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে গতকাল মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে চিঠি পাঠায় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় । এই চিঠির সঙ্গে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উত্থাপনের জন্য সারসংক্ষেপও পাঠানো হয়েছে । নিয়ম অনুযায়ী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এখন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবটি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উত্থাপন করে । এনবিআর ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ গঠন করে গত ১২ মে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার । এর প্রতিবাদে আন্দোলনে নামেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীরা । পরে সরকার আন্দোলনরতদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে । এরপর কর্মচারীরা আন্দোলন স্থগিত করলেও এনবিআর চেয়ারম্যানের পদত্যাগসহ বিভিন্ন দাবিতে গত শনিবার থেকে সারা দেশে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি শুরু করেন । এতে বিভিন্ন বন্দরে খালাস ও রপ্তানির অপেক্ষায় থাকা পণ্যের শুল্কায়ন ও দাপ্তরিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে । আমদানি - রপ্তানি ও বৈদেশিক বাণিজ্যে চলমান এই স্থবিরতা কাটাতে এনবিআরের অধীন সব চাকরিকে অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস ঘোষণা করছে সরকার ।

কী আছে আইনে ?

২০২৩ সালের ৬ এপ্রিল অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা আইন জারি করে সরকার । এই আইনে অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা বলতে কোন কোন পরিষেবাকে বোঝানো হবে , তা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে । পাশাপাশি যেকোনো সেবাকে অত্যাবশ্যক পরিষেবা হিসেবে ঘোষণার এখতিয়ার সরকারকে দেওয়া হয়েছে । এ - সংক্রান্ত ধারায় বলা হয়েছে , সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দিয়ে চার ধরনের চাকরি বা কোনো শ্রেণির চাকরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো পরিষেবাকে অত্যাবশ্যক পরিষেবা হিসেবে ঘোষণা করা যাবে । এর মধ্যে জনকল্যাণমূলক সেবা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে এবং জননিরাপত্তা বা জনগণের জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণ সেবা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে এসব পরিষেবাকে গেজেট প্রজ্ঞাপন দিয়ে ৬ মাস পর্যন্ত অত্যাবশ্যক পরিষেবা হিসেবে ঘোষণা করে এর মেয়াদ ৬ মাস করে বাড়ানো যাবে ।

আইনে বলা আছে, ‘ সরকার কোনো ধর্মঘট নিষিদ্ধ ঘোষণা করা আবশ্যক বিবেচনা করলে সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দিয়ে উক্ত আদেশে বর্ণিত এক বা একাধিক অত্যাবশ্যক পরিষেবার ক্ষেত্রে ধর্মঘট নিষিদ্ধ করতে পারবে । কোনো প্রতিষ্ঠানে লকডাউন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা আবশ্যক বিবেচনা করলে সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দিয়ে এক বা একাধিক পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে লকডাউন নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে । ফলে চাকরিরত কোনো ব্যক্তি ধর্মঘট আরম্ভ করতে বা চলমান রাখতে পারবেন না । নিয়োজিত কোনো প্রতিষ্ঠান লকডাউন বা লে - অফ ঘোষণা করতে বা চলমান রাখতে পারবে না । এসব অমান্য করলে এক বছর জেল , ২৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে । কেউ বেআইনি ধর্মঘটে অংশ নিলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াও বিধি মোতাবেক একাধিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে । '

কেন এ পথে সরকার ? সরকারি কর্মচারীদের দলবদ্ধভাবে আন্দোলনের পথ বন্ধ করতে সরকারি চাকরি আইন সংশোধন করে ২৫ মে সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ জারি করে সরকার । কিন্তু এই অধ্যাদেশ জারির পর সচিবালয়ে কর্মচারীরা নজিরবিহীন বিক্ষোভ - সমাবেশ করেন । পরে অধ্যাদেশ পর্যালোচনায় গত ৪ জুন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করে সরকার । এই কমিটি এখনো তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়নি । কমিটির প্রতিবেদন নিয়ে সরকার সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ সংশোধন করবে বলে কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছেন । চাকরি অধ্যাদেশ জারি করলেও কর্মচারীদের আন্দোলনের কারণে এটি এখনো প্রয়োগ করেনি সরকার । ১৯ জুন পাঁচজন সচিবকে সরকারি চাকরি আইন অনুযায়ী বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে । জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন , সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের প্রয়োগ শুরু হলে এই অধ্যাদেশ দিয়েই সরকার এনবিআর কর্মীদের আন্দোলন থামিয়ে দিতে পারত । কারণ সরকারের নির্দেশ অমান্য করে কেউ আন্দোলন করলে তার বিরুদ্ধে সহজেই ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ চাকরি অধ্যাদেশে রয়েছে ।

পক্ষে-বিপক্ষে মত

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া মনে করেন , উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আন্দোলন দমনের পদক্ষেপ না নিয়ে সরকারের আর কোনো উপায় নেই । তবে দমনপীড়ন না করে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক সচিব আবু আলম মো . শহীদ খান ।ফিরোজ মিয়া বলেন , এভাবে তো একটি দেশ চলতে পারে না । কেউ নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন করতে পারে ; কিন্তু জাতিকে জিম্মি করে তো আন্দোলন হতে পারে না । সরকার যদি কঠোর অবস্থানে যায় , তাহলে সামাল দেওয়া কঠিন হবে । শুধু এনবিআরে না , সচিবালয়ে মারামারি হয়, সিটি করপোরেশনে মারামারি হয় , বন্ধ থাকে । যে যার খুশিমতো করছে ।

এ রকম হলে দেশের কী হবে ? কর্মচারীরা জনস্বার্থে নয় , গোষ্ঠীস্বার্থে আন্দোলন করছেন । সরকারকে জিম্মি করে নিজেদের সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে । এসব জায়গায় কঠোর হওয়া ছাড়া তো উপায় থাকে না । এনবিআরের চাকরি অত্যাবশ্যকীয় ঘোষণা করার পর কোনো প্রভাব পড়লে তখন দমন করতে হবে । সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ ভালোমতো করলে , এই অধ্যাদেশ দিয়েই তাদের নিবৃত্ত করতে পারত । এনবিআর ও এর অধীন দপ্তর- সংস্থার চাকরিকে অত্যাবশ্যকীয় ঘোষণা করা একেবারেই যৌক্তিক হবে না মত দিয়ে আবু আলম শহীদ খান বলেন , দমনপীড়নের মধ্য দিয়ে , বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে কোনো আন্দোলন দমানোর চেষ্টা তো গণতান্ত্রিক চেষ্টা নয় । অবশ্যই সরকারের উচিত আলাপ - আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান বের করা । আলাপ- আলোচনার মাধ্যমে সমাধান বের করাই হলো উত্তম পথ । জঙ্গি আইন প্রয়োগ করে এটাকে দমন করবে , তার ফলাফল ভালো হবে না । তখন আন্দোলন করবে না ; কিন্তু ধীরে চলো নীতিতে চলবে , ঠিকমতো কাজ করবে না , তখন কী করবেন ? ফলে যেকোনো সমস্যা সমাধানের পথ হলো আলোচনা ।

আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান না হলে সরকারের করণীয় কী , সে প্রশ্নে শহীদ খান বলেন , এখানে সমাধানে আসা কোনো কঠিন কাজ নয় । কর্মচারীরা এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ চেয়েছেন । কর্মকর্তার কি অভাব আছে ? এনবিআর চেয়ারম্যান হওয়ার মতো উপযুক্ত লোক খুঁজলে এক শ জন পাবেন । এটা নিয়ে তো কোনো গোঁয়ার্তুমি করার দরকার নেই । এর আগে এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ নিয়ে কোনো আন্দোলন হয়নি । কেন এই আন্দোলন হচ্ছে , সেটা চেয়ারম্যান , উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা পরিষদকে বুঝতে হবে । গায়ের জোরে রাখার তো কোনো বিষয় না । রাষ্ট্রের কর্মচারী যেকোনো জায়গায় কাজ করতে পারে । একজন নতুন চেয়ারম্যান দিয়ে যদি সমস্যার সমাধান হয় , তাহলে তো তা ইমিডিয়েটলি করে ফেলা যায় । তারপর আলাপ - আলোচনার ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান করা যায় ।