Image description

গণমাধ্যম খবর করলো, বিমানবন্দনে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের ব্যাগেজে ‘অ্যামোনেশন’ ম্যাগাজিন। এই অ্যামোনেশন বিষয়টি না বুঝতে-বুঝতেই খবর উধাও। কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই খবরটি তুলে নিল গণমাধ্যমটি। অনেকে এই ‘অ্যামোনেশন’ শব্দটির বিষয়ে বিভ্রান্ত হয়ে একে অ্যামুনিশন ম্যাগাজিন বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো। অ্যামুনিশন মানে কোনো ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রের গুলির ম্যাগাজিন। বোঝেন অবস্থা, একটা বিভ্রান্তিকর শব্দের কারণে বিষয় কতটা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে! একজন উপদেষ্টার ব্যাগেজে গুলির ম্যাগাজিন, চিন্তা করা যায়। একজন উপদেষ্টা কেন একটি অ্যামুনিশন ম্যাগাজিন আনবেন, তাও বিদেশ থেকে, এই প্রশ্নটি কি কারো মাথায় আসেনি! দরকার হলে তো দেশেই সংগ্রহ করা যায়। অর্থাৎ ঘটনাটি যদি সত্যিও হয়ে থাকে, তবে এর পেছনে আসিফকে কলঙ্কিত করার কোনো চেষ্টা রয়েছে কিনা তাও তো খতিয়ে দেখা উচিত, নয় কি? আসিফকে কেন টার্গেট করা হলো, তার উত্তর হয়তো এ লেখাতেই পাওয়া যাবে। অবশ্য উত্তর সবারই জানা, শুধু উদ্দেশ্যটা ভিন্ন। 

গণমাধ্যমে খবরের টুইস্ট নিয়ে অনেকদিন ধরেই বলে আসছি। বলে আসছি, অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট লবি সফট্ পাওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে কখনো নেয়নি। ফলে ফ্যাসিজমের স্লিপার সেল সক্রিয় হয়েছে। অনেকে আনন্দিত হতে পারেন যে, জুলাই আন্দোলন থেকে উঠে আসা আসিফ মাহমুদের গায়ে কালি লাগানো গেছে। এই আনন্দে বিএনপি’র কেউ কেউ শরিক হতে পারেন। কারণ এই উপদেষ্টারা তাদের কারো কারো কাছে রাইভাল হয়ে উঠেছেন। কিন্তু এই আনন্দ নিমেষেই ফিকে হয়ে যাবে, যদি কুমিল্লা মুরাদনগর ধর্ষণের বার্নিং ইস্যু নিয়ে কথা বলতে যান। দেখবেন, সেখানে ধর্ষণকারীকে গণমাধ্যম প্রথমে কোনো দৃশ্যমান প্রমাণ ছাড়াই বিএনপি’র লোক বানিয়ে দিয়েছে। অথচ পরে দেখা গেল সেই ধর্ষণকাণ্ডে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগের সথে সংশ্লিষ্ট। সুতরাং আসিফ মাহমুদকে নিয়ে খবরের যে টুইস্ট তাতে আনন্দিত হবার কিছু নেই। 

এই টুইস্ট চলতেই থাকবে এবং এই টুইস্টের আপাত লক্ষ্য হচ্ছে জুলাই আন্দোলনের তরুণ যোদ্ধারা। কারণ তাদের কলঙ্কিত করা গেলে জুলাই বিপ্লবকেও কলঙ্কিত করা যাবে। আর জুলাই বিপ্লব কালিমালিপ্ত হলে উদ্ভাসিত হবে ফ্যাসিজম। সুতরাং এই টুইস্ট চলবে জুলাই আন্দোলনের সমুখযোদ্ধাদের কলঙ্কিত করতে, প্রশ্নবিদ্ধ করতে। যেখানে গণমাধ্যমে খবর হওয়া উচিত ছিল হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের বিষয়ে। দেড় দশকের গুম-খুনের বিরুদ্ধে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে ভয়াল জনপদে পরিণত করার বিরুদ্ধে। সেটা না করে, কোন জুলাইযোদ্ধা ফোনে কার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতে চেয়েছে সে খবরকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। যেন সেই জুলাইযোদ্ধার ব্যক্তিগত কেলেঙ্কারি ফাঁস হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

পাচারকৃত লক্ষ-কোটি টাকা ফেরত আসবে। বিদেশের বেগমপাড়া বন্ধ হবে। লন্ডনে বাজেয়াপ্ত হওয়া ১৫৪ কোটির বাড়ি বিক্রি করে মানুষকে দান করা হবে। গণমাধ্যমের ফাতরামো দেখলে অন্তত তাই মনে হয়। ব্যক্তিগত ফোনালাপ যারা ফাঁস করে, তারাও সমান দোষী। কারণ ব্যক্তিগত ফোনালাপ যা একান্তই ব্যক্তিগত তা ফাঁস হলে রাষ্ট্রের কোনো লাভ হয় না। রাষ্ট্রের লাভ না হলে সামষ্টিক জনগণের কোনো লাভ হয় না। লাভ হয় শুধু পতিত ফ্যাসিস্টদের। তারা দাঁত কেলিয়ে বলতে পারে, আমরাই ভালো ছিলাম। হ্যাঁ, তাদের ভালো বলতেই গণমাধ্যমের টুইস্টের নামে এই ইতরামো। লোকসান হয় শুধু সেই ব্যক্তির, যার ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে। তার ব্যক্তিচরিত্র কলঙ্কিত হয়। সে যদি কোনো রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকেন, তাহলে সেই রাজনৈতিক শক্তিও কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের চলায় বাধা পড়ে। 

জুলাই বিপ্লবের সপক্ষের রাজনৈতিক শক্তিকে বিভক্ত করতে গণমাধ্যম এমন কোনো ইতরামো নেই যা করতে বাকি রাখছে। বলতে পারেন, সব গণমাধ্যম তো নয়। তাতে কী, যারা ভালো গণমাধ্যম বলে নিজেদের দাবি করছে, তারাও কি এই ইতরামোর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে? দাঁড়ায়নি, তাহলে ভালো হলো কী করে? ২৪ এর আগস্ট মাসটা পর্যন্তই শুধু গণমাধ্যম চুপ করে ছিল। কিন্তু সেপ্টেম্বর থেকেই তারা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে এবং সেই ঘুরে দাঁড়ানো হলো ফ্যাসিজমের পক্ষে। জানি, এখানে অনেকেই প্রশ্ন তুলবেন, সম্পাদক বদল হয়েছে, মালিকানা বদল হয়েছে ইত্যাদি, ইত্যাদি। কিন্তু মুশকিল হলো, বাংলাদেশের সম্পাদকরা যখন মোটা বেতন পান এবং ক্ষমতার স্পেস পান, তখন তাদের জ্ঞানের কাণ্ড শূন্য হয়ে যায়। তারা একবেলা অফিসে আসেন, ডামিতে একবার চোখ বোলান, তারপর আর খবর নেই। সেই চোখ বুলানোও হয় শূন্য দৃষ্টিতে। বোলাতে হয় বলে বোলান। তারা জানেন, না বুলালেও কিছু যায় আসে না। তাদের নামই সবকিছু ম্যানেজ করতে সহায়তা করবে। সুতরাং খবরের জায়গায় ঠিকই টুইস্ট রয়ে যায়। 

আজকে যারা জুলাইযোদ্ধাদের কলঙ্কিত করার চেষ্টা করছেন, তাদের টার্গেট যে জুলাই যোদ্ধা নয়, তাদের টার্গেট ভবিষ্যত ক্ষমতাশীন দল, অর্থাৎ বিএনপি, তা বুঝতে দিকগজ হওয়া লাগে না। ইতোমধ্যে যে ফোর্সটা বিএনপির জন্য ঢাল হতে পারতো তাদের বিএনপি’র বলয় থেকে সুকৌশলে আলাদা করে ফেলা হয়েছে। তরুণ যোদ্ধাদের বিএনপির শত্রু বানিয়ে দেয়া হয়েছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বড় অংশই এখন বিএনপির বিপক্ষে।  আর এর অনেকটাই করেছে গণমাধ্যম। তারা ন্যারেটিভ তৈরি করেছে। তারা বাধ্য করেছে তরুণ যোদ্ধা আর বিএনপিকে মুখোমুখি হতে। ফলে জুলাই বিপ্লব থেকে উঠে আসা নাহিদ, হাসনাত, আসিফদের যেমন প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে, তেমনি হতে হচ্ছে বিএনপির নেতাকর্মীদের। বিএনপির কোনো নেতার বাড়িতে রিলিফের দুই বস্তা চাল পাওয়া গেলে এমনভাবে প্রচার করছে গণমাধ্যম যেন এস আলমের চুরি করা ছাপান্ন হাজার কোটি টাকাও তার কাছে নস্যি। গণমাধ্যমের মধ্যে বসে থাকা স্লিপার সেল বিএনপি নেতার দুই বস্তা চাল চুরিকে অলিগার্ক এস আলমের ছাপান্ন হাজার কোটি টাকা চুরির ঘটনার সমান করে ফেলছে। যে কারণে ফ্যাসিস্টদের কৃত অপরাধ অনেকটাই সরলীকরণ হয় যাচ্ছে । 

পাভেল নামে এক অভিনেতা যে কিনা ভারতীয় রিয়েলিটি শোতে অংশগ্রহণ করেছিল, সেই ‘রাম-ইয়ে’কে দেখলাম লিখেছে, স্বৈরাচারের চেয়ে ধর্ষকরা খারাপ। গণমাধ্যম এটাকে ফটোকার্ডও করেছে! এই ‘রাম-ইয়ে’টা বোধহয় জাহাঙ্গীরনগরের মানিকের নাম শোনেনি, যে ধর্ষণে সেঞ্চুরি পার করে রীতিমত উৎসব করেছিল। এই ‘রাম-ইয়ে’টার বোধহয় খাদিজার কথা মনে নেই। এইসব ‘রাম-ইয়ে’রাও এখন জুলাই বিপ্লব নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ফরাসি বা বলশেভিক বিপ্লবের পর এমন প্রশ্ন তুললে সরাসরি দড়িতে ঝুলিয়ে দিত, না হয় গিলোটিনে গলা নামিয়ে দিত। কিন্তু বাংলাদেশের বিপ্লবীরা সে তুলনায় অনেকটাই সহনশীল। তাই পাভেলরা বিপ্লবকে প্রশ্নবিদ্ধ করেও প্রশ্নের মুখে পড়ে না। বিচারের মুখোমুখি হয় না। 

যখন লিখছি তখন জুলাই শুরু হতে দু’দিন বাকি। একবছর হতে চললো। কিন্তু এখনো শহীদের কাফেলা থামেনি। থামেনি আহতদের আর্তনাদ।  স্বজনহারাদের আহাজারি। এরমধ্যেই গণমাধ্যম জুলাই বিপ্লবকে ম্লান করে দিতে উঠে-পড়ে লেগেছে। জুলাই বিপ্লবের নায়কদের কলঙ্কিত করছে। সাথে প্রস্তুতি নিচ্ছে ভবিষ্যৎ ক্ষমতাশীন বিএনপিকে কলঙ্কিত করার মূল মিশনের। -