Image description
ঢাকার চারপাশের নদীগুলো মৃতপ্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার মহাপরিকল্পনাতেও সুফল নেই বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নদীদূষণের সঙ্গে সম্পর্কিত পরিবেশগত, স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ২৮৩ কোটি ডলার

দখল ও দূষণের ফলে রাজধানী ঢাকার চারপাশের নদীগুলো এখন মৃতপ্রায়। নদীগুলোর দূষণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, পানির রং কালচে হয়ে গেছে। নদীর পাড় দিয়ে হাঁটলে পচা দুর্গন্ধে নাকে রুমাল দিতে হয়। নদীর পানিতে মাছ তো দূরে থাক, পোকা-মাকড়ও বাঁচতে পারে না। দখল আর দূষণে নদীগুলো পরিণত হয়েছে খাল ও নর্দমায়। এসব নদীর পানি শোধনেরও অযোগ্য। তাই তো ওয়াসা ঢাকাবাসীকে যে পানি সাপ্লাই দিচ্ছে সেটি মুন্সীগঞ্জের পদ্মা নদী থেকে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর আগে শীতলক্ষ্যার পানি শোধন করে ঢাকাবাসীকে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে শীতলক্ষ্যার দূষণও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নদীদূষণের সঙ্গে সম্পর্কিত পরিবেশগত, স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ২৮৩ কোটি ডলার। এ পরিস্থিতি নিরসনে কোনো কার্যকর উদ্যোগ না নেয়া হলে আগামী পাঁচ বছর পর এ ক্ষতি দিগুণ থেকে তিনগুণে পৌঁছাবে।

ঢাকার চারপাশের প্রধান নদ-নদীগুলো হলোÑ বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু। এসব নদী দখল ও দূষণমুক্ত করে প্রবহমান করতে বিভিন্ন সময় নানান প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সর্বশেষ একটি মহাপরিকল্পনা নিয়েই কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। এসব প্রকল্প ও মহাপ্রকল্পের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। দূষণ ও দখলে বিপর্যস্ত এই চার নদীকে রক্ষায় ২০০৯ সালে প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা (ইকোলোজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া-ইসিএ) ঘোষণা করে সরকার। ঘোষণার ১৬ বছর পার হলেও তা আজো বাস্তবায়ন হয়নি। ২০১৮ সাল পর্যন্ত হাকালুকি হাওর ও কক্সবাজার জেলার কিছু জায়গায় ইসিএ বাস্তবায়নে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও রাজধানীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা এই নদীগুলোর ক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি। বিশেষজ্ঞরা পরিবেশ অধিদফতরের এই ভূমিকাকে ‘রহস্যজনক’ বলে মনে করছেন। বিশেষ করে বর্তমান পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা চৌধুরী এতদিন একজন এনজিওকর্মী হিসেবে নদীদূষণ ও দখলমুক্ত করার আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি এখন এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। অথচ তিনি এ ব্যাপারে শুধু গালভরা বুলি ছাড়া দৃশ্যমান কিছুই করছেন না। এটি শুধু বিশেষজ্ঞ নন, সাধারণ মানুষের কাছেও রহস্যজনক।

২০০৯ সালের জুন মাসে দেয়া উচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে সরকার রাজধানীর চারদিকে বৃত্তাকারে প্রবাহিত বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদী রক্ষার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ প্রকল্পের আওতায় নদীর দুই পাড়ে ৫২ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, তীররক্ষা বাঁধ, ভরাট হওয়া মাটি খনন, ১০০টি আরসিসি সিঁড়ি, এক কিলোমিটার কি-ওয়াল, সেতু ও রেলিং নির্মাণ, ৪০৯টি বসার বেঞ্চ, ১০ হাজার ৮২০টি সীমানা পিলার, তিনটি ইকোপার্ক, ১৯টি জেটি, ছয়টি লং বুম এস্কেভেটর ক্রয় ও নদীর তীরে বনায়ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এই মহাপরিকল্পনার নামে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা লুটপাট হলেও নদীর জীবন ফিরে আসেনি। অনেকে বলছেন, এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রকৃত রোগের চিকিৎসা না করে উপর দিয়ে কসমেটিক সাজারি করা হয়েছে। নদীকে দূষণমুক্ত না করে এর পাড়ে সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে।

ঢাকার প্রধান চারটি নদী বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালুর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে সাত হাজার শিল্প-প্রতিষ্ঠান। এসব শিল্প-প্রতিষ্ঠানের বর্জ্যে নিষ্কাশনের জন্য নিজস্ব ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে তা নেই। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিদিন নদীর পানিতে মিশ্রিত তরল বর্জ্যরে পরিমাণ ৮০ হাজার কিউবিক মিটার। বুড়িগঙ্গা নদীর ২৫৮টি পয়েন্ট দিয়ে গৃহস্থালি পয়ঃবর্জ্য ও শিল্পবর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ছে। তুরাগ নদের ২৬৯টি এবং বালু নদের ১০৪টি ও টঙ্গী খালের ৬২টি পয়েন্ট দিয়ে কঠিন বর্জ্য এবং পয়ঃবর্জ্য নিঃসরিত হচ্ছে। এছাড়া আরো অনেক দূষণ পয়েন্ট রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এ ছাড়া ঢাকা শহরের লোকালয় থেকে প্রতিদিন সৃষ্ট আবর্জনার পরিমাণ ৪৫ হাজার টন। যার ৮০ শতাংশ মিশে বুড়িগঙ্গায় পানিতে। প্রতিদিন ১২ হাজার কিউবিক মিটার পয়ঃবর্জ্য বুড়িগঙ্গায় মিশ্রিত হয়। দৈনিক গড়ে পাঁচ হাজার যান্ত্রিক নৌযান চলাচল করে বুড়িগঙ্গা দিয়ে। যাদের সব ধরনের বর্জ্যরে শেষ ঠিকানা হলো বুড়িগঙ্গা। জাহাজ রিপেয়ার ইন্ডাস্ট্রিগুলোর বর্জ্য ডাম্প করা হয় বুড়িগঙ্গায়। বুড়িগঙ্গায় এখন কোনো মাছের আবাস নেই বললেই চলে। এ নদীর পানিতে এখন অক্সিজেনের পরিমাণ জিরো। তাই বিশেষজ্ঞরা একে নদী না বলে সেপটিক ট্যাংক বলেই অবিহিত করছেন। অথচ এই নদীর এই দূষিত পানিকে দূর না করে এর তীরে বনানয়ন, সৌন্দর্য বর্ধন, পার্ক নির্মাণ, সীমানা পিলার নির্মাণÑ ইত্যাদি কাজ করে লুটপাট করা হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। কলকারখানার ক্যামিকেল ও বর্জে নদীর পানি সরাসরি দূষিত হলেও পরিবেশ অধিদফতর এ ব্যাপারে নীরব।

পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এ বিষয়ে বলেন, নদীদূষণ ও দখলমুক্ত করায় পানি ব্যর্থ, কিছুই করিনি, করতে পারিনিÑ এ সব বিষয় সোশ্যাল মিডিয়াসহ নানা মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। যারা প্রচার করছেন তাদের কাছে প্রশ্নÑ গত ৫৩ বছরে এটি হয়নি কেন? আসলে আমরা রাতারাতি সব করে ফেলতে পারবÑ এমন নয়। আমরা নদীগুলো বাঁচানোর একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। আসলে অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে আমরা চারটি নদীর দূষণমুক্ত করার কাজ হাতে নিতে পারিনি। আমরা এখন শুধু তুরাগকে দূষণমুক্ত করার কাজ শুরু করেছি। অন্যগুলোরও পরিকল্পনা আমরা চূড়ান্ত করে যাচ্ছি। পরবর্তী সরকার এসে সেটি সম্পন্ন করতে পারবে।